বিশ্বনেতাদের চোখে মহান দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধু

মাহফুজ সাদি •


ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্তির পর ভারতবর্ষের দুই অংশ বিভক্ত হয়ে জন্ম নেয় পাকিস্তান। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর নতুন শোষণের মুখে পড়ে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিরা। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হলে ফুঁসে ওঠে পুরো জাতি, যার নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধিকার চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে দায়ের করা হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। ৬৯-এর নির্বাচনে পুরো পকিস্তানে জয়লাভ করার পরও সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি বঙ্গবন্ধুকে। উল্টো তাকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করতে থাকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকার। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে ‘মহান দেশপ্রেমিক’ হিসেবে চিরদিনের জন্য পাকাপোক্ত অবস্থান করে নেন বঙ্গবন্ধু। ‘দেশদ্রোহী’র তকমা থেকে জাতির পিতার ‘মহান দেশপ্রেমিক’ হয়ে ওঠার বিষয়টি তার এককালের ঘোরতর শত্রুরাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।

বিষয়টি উঠে এসেছে একাত্তরে বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেওয়া পাকিস্তানের (বেলুচিস্তান) সাবেক অফিসার মেজর জেনারেল তোজাম্মেল হোসেন মালিকের স্মৃতিকথায়। তিনি লিখেছেন, ‘বস্তুত মুজিব দেশদ্রোহী ছিলেন না (পাকিস্তানে তাকে সেভাবে চিত্রিত করা হলেও)। নিজ জনগণের জন্য তিনি ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক।’

কেবল মালিকই নন, তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তার মুখপাত্র মেজর সিদ্দিক সালিকও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। ‘পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল’ গ্রন্থে তিনি লেখেন, ‘রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের (ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ) পর ঘরমুখী মানুষের ঢল নামে। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল আশাব্যঞ্জক বাণী শ্রবণ শেষে মসজিদ অথবা গির্জা থেকে তারা বেরিয়ে আসছেন।’

এ তো গেলো বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের ভাষ্য। সেই সময়ের পাকিস্তানি রাজনীতিকরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কী ভাবতেন? ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে করাচি থেকে প্রকাশিত জুলফিকার আলী ভুট্টোর ‘দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি’ বই থেকে তার একটা ধারণা দেওয়া যাক। মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার ওই সময়েও বইটিতে তিনি স্বীকার করেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনে জয়লাভের পর ৬ দফার প্রশ্নে একেবারেই আপসহীন ছিলেন। তাতে পাকিস্তান বিভক্ত হলেও তার কোনও আপত্তি ছিল না।’ এভাবেই ‘দেশদ্রোহী’ তকমা থেকে ‘মহান দেশপ্রেমিক’-এ পরিণত হন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে লড়াই করা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও বঙ্গবন্ধুকে ‘দেশপ্রেমিক’ নেতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ২০১৩ সালের ৪ মার্চ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের পরিদর্শন বইয়ে প্রণব মুখার্জি লিখেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বঙ্গবন্ধু খেতাবে এই দেশপ্রেমিক নেতার প্রতি দেশের মানুষের গভীর ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়।’

বাংলাদেশ সফরে এসে একই মন্তব্য বইতে মনমোহন সিং লেখেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সম্মোহনী এবং অসীম সাহসীকতার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষমতায় থাকা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর ভাষ্য, ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নেতা এবং রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। তিনি স্বাধীনতার জন্য প্রতিকূলতা ও বিরূপ পরিস্থিতি উপেক্ষা করে অটল সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছেন।’

বাংলাদেশ লাগোয়া এবং মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় আশ্রয় শিবিরে পরিণত হওয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় ঢাকা সফরে এসে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। মন্তব্য বইতে তিনি লেখেন, ‘এই উপ-মহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং পিতা। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মঞ্চে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বে মর্যাদা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই বিরল নেতা, যার প্রতি ধর্ম-মত নির্বিশেষে সকল মানুষ প্রণাম জানিয়ে ধন্য হয়।’

এই অঞ্চলের আরেক দেশ শ্রীলংকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষ্মণ কাদির গামা বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, ‘গত কয়েক শতকে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বকে অনেক শিক্ষক, দার্শনিক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সব কিছুকে ছাপিয়ে, তাঁর স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে।’

এশিয়া ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের জ্যোতি ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ থেকে ল্যাটিন আমেরিকা পর্যন্ত। এমনকি বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তি কিউবার বিপ্লবী নেতা প্রয়াত ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

বিশ্ব গণমাধ্যমেও বঙ্গবন্ধুকে ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ বা ‘রাজনীতির ছন্দকার’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিবিসি’র এক জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরামহীন সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য বিশ্বশান্তি পরিষদ প্রদত্ত ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সজাতির বিপথগামী কিছু সেনার হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি। এই মহান নেতার জন্মদিন আজ ১৭ মার্চ (শুক্রবার)।

আরও খবর