উপজেলায় ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে বেকায়দায় সরকার

উপজেলা স্তরে সরকারি প্রশাসনিক কাজকর্ম নির্বাচিত পরিষদের নেতৃত্বে পরিচালনার লক্ষ্য বাস্তবায়নে দীর্ঘদিনের জটিলতার অবসান ঘটছে না। এ নিয়ে সরকার বেকায়দায়।

সংশ্নিষ্ট আইন ও বিধিতে থাকা আদালতের নির্দেশনা এবং বিভিন্ন সময়ে সরকারি আদেশ-নির্দেশে উল্লেখ সত্ত্বেও গত দেড় দশকে নির্দিষ্টসংখ্যক কার্যক্রম ও দপ্তরগুলো উপজেলা পরিষদের অধীনে ন্যস্ত করা যায়নি। এ জটিলতা নিরসনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত এ-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ১৯তম বৈঠকে বসতে যাচ্ছে।ম

গত মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মন্ত্রিসভা কক্ষে এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। আগের বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা, উপজেলায় ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে গঠিত উপকমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা এবং রিট মামলা-সংক্রান্ত বিষয় ছিলো আলোচ্যসূচিতে।

উপজেলার সব কার্যক্রম নিজেদের নেতৃত্বে পরিচালিত করার দাবি অনেক আগে থেকেই করে আসছেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আদেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা প্রতিপালন হচ্ছে না বলে অভিযোগ এনে আদালতে রিট করেছেন চেয়ারম্যানরা। এ পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা-সংক্রান্ত বিধান প্রতিপালনে নির্দেশ দেন।

বৈঠকে উপজেলায় ১৭টি দপ্তরের হস্তান্তর-সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে গঠিত উপকমিটির প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। উপকমিটির পক্ষ থেকে ১৭ দপ্তর হস্তান্তর-সংক্রান্ত বিষয়টি ‘অস্পষ্ট’ ও ‘অসমঞ্জস’ উল্লেখ করে সেগুলো স্থগিত বা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

উপজেলা পরিষদে সরকারি ১৭টি দপ্তর হস্তান্তরের দাবিতে চেয়ারম্যানরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। কিন্তু সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের অভাব ও মাঠ প্রশাসনের অনীহায় এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে চেয়ারম্যানরা আদালতে গেলে উপজেলা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে আইন-বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন আদালত। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জিল্লুর রহমান চৌধুরীর (বর্তমানে খুলনার বিভাগীয় কমিশনার) নেতৃত্বে একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। উপকমিটিকে দপ্তর হস্তান্তর-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের সুপারিশ দিতে বলা হয়।

এ কমিটি উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরের জন্য যেসব আদেশ-নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো ‘অস্পষ্ট’ ও ‘অসমঞ্জস’ উল্লেখ করে সেগুলো স্থগিত বা বাতিলের সুপারিশ করে। উপজেলা-সংক্রান্ত আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী এটা সম্ভব। একই সঙ্গে পরিবর্তিত সময়ের নিরিখে উপজেলা পরিষদ আইনে সংশোধনের সুপারিশ করেছে উপকমিটি।

উপকমিটি বলছে, উপজেলা চেয়ারম্যানরা আদালতে যে প্রতিকার চেয়েছেন, তা বিদ্যমান আদেশ-নির্দেশ অনুযায়ী যৌক্তিক। এ ক্ষেত্রে জারি করা সিদ্ধান্ত স্থগিত বা বাতিল না করলে সরকারের পক্ষে আদালতে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার সুযোগ নেই। সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, এ কারণেই সরকার বেকায়দায় রয়েছে।

উপকমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকারের নিয়োগ করা জনবল উপজেলা পরিষদের অধীনে দেওয়ার সুযোগ নেই। যুক্তি হলো, বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজ নিজ দপ্তর থেকে বেতন-ভাতা পান। কিন্তু উপজেলা পরিষদে সরকারি জনবল হস্তান্তর হলেও তাঁদের বেতন-ভাতাসহ সার্বিক খরচ সরকারকে বহন করতে হবে।

এতে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপজেলা পরিষদ আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। তাই উপজেলা পরিষদের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের উদ্যোগ নিতে বলেছে উপকমিটি।

এ ছাড়া উপকমিটির প্রতিবেদনে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হতে অনিচ্ছার কথা বলা হয়েছে। ১৭টি দপ্তর উপজেলায় হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হলে আগের মতো কর্মচারী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আপত্তি আসতে পারে।

উপজেলা পরিষদ প্রবর্তনের পর প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৮৫ সালে। বিএনপি সরকার ১৯৯১ সালে উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৮ সালে আবার উপজেলা পরিষদ আইন করলেও নির্বাচন হয়নি। বিএনপি ২০০১ সালে আবারও ক্ষমতায় এলে উপজেলা কার্যকর করেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রথমবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয় ২০০৯ সালে। উপজেলা আইন অনুযায়ী ১৩টি মন্ত্রণালয়ের ১৭টি দপ্তরের ৩৯টি অফিস উপজেলা চেয়ারম্যানদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা।

বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বীরু গত রোববার বলেছেন, আইন-বিধি অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য তাঁরা অনেক আগে থেকেই দাবি জানাচ্ছেন; কিন্তু সমাধান পাননি। এখন বিষয়টি আদালতে আছে। আদালত যে আদেশ দেবেন, তা তাঁরা মেনে নেবেন।

আরও খবর