স্ত্রীর পরিকল্পনায় স্বামীকে হত্যার পর ছয় খণ্ড করেন ইমাম

ডেস্ক রিপোর্ট •

রাজধানীর দক্ষিণখানে চাঞ্চল্যকর পোশাকশ্রমিক আজহারুল ইসলাম হত্যা মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছে পুলিশ। এতে দক্ষিণখান সরদারবাড়ি জামে মসজিদের তৎকালীন ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান ও নিহতের স্ত্রী আসমা আক্তারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। দুই আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ফারুক মিয়া এ অভিযোগপত্র জমা দেন।

২০২১ সালের ২০ মে দক্ষিণখান সরদারবাড়ি জামে মসজিদে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। হত্যার পর আজহারুলের মরদেহ ছয় টুকরো করেন ইমাম আব্দুর রহমান। পরে তা মসজিদের সেপটিক ট্যাংকিতে ফেলে দেন। ঘটনার চারদিন পর ২৪ মে মরদেহ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ঘটনায় ২০২১ সালের ২৬ মে দক্ষিণখান থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন নিহতের ভাই হাসান। প্রায় ২২ মাস পর মামলার তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, হত্যার শিকার আজহারুল ইসলাম মামলার আসামি আসমা আক্তারের তৃতীয় স্বামী। তাদের এক ছেলে সন্তান রয়েছে। সন্তান নিয়ে এ দম্পতি দক্ষিণখান থানা এলাকায় বসবাস করতেন। তাদের একমাত্র ছেলে সরদারবাড়ি জামে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতো। মসজিদে আসা-যাওয়া করায় তার সঙ্গে তৎকালীন ইমাম আব্দুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয়। রহমান ওই মসজিদে প্রায় ৩৩ বছর ইমামতি করেছেন।

ওই মসজিদের সামনে প্রায়ই খেলাধুলা করতো আজহারুল-আসমার ছেলে। এসময় তাকে চকলেট কিনে দিতেন ইমাম আব্দুর রহমান। কোনো একদিন খেলতে গিয়ে আঘাত পায় আজহারুলের ছেলে। খবর শুনে কয়েকবার বাড়িতে গিয়ে তাকে দেখে আসেন আব্দুর রহমান। এ সুবাদে আজহারুলের স্ত্রী আসমার সঙ্গে ইমাম আব্দুর রহমানের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে ইমামের কাছে আরবি পড়া শুরু করেন আসমা ও তার ছেলে। আজহারুলের বাড়িতে ইমাম আব্দুর রহমানের নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয়।

এর মধ্যে আব্দুর রহমানের সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আসমা আক্তার। একদিন বাড়িতে ঢুকে আব্দুর রহমান ও আসমাকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলেন আজহারুল। কাজের কারণে প্রায়ই বাইরে থাকতেন আজহারুল। এ সুযোগে আব্দুর রহমানের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আসমা। তাদের শারীরিক মিলনের দৃশ্যও সরাসরি দেখে ফেলেন আজহারুল। এ নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তার বাগবিতণ্ডা হয়। স্ত্রীকে শাসন করেন এবং মোবাইল ভেঙে ফেলেন আজহারুল।

আব্দুর রহমান-আসমার পরকীয়া আজহারুল ধরে ফেলেন। তাদের শাসনও করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আজহারুলকে হত্যার ছক কষতে শুরু করেন ইমাম রহমান ও আসমা। এর অংশ হিসেবে খাবারের সঙ্গে টিকটিকি ও জামালগোটা ফল মেশানো হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে এমন তথ্য তুলে ধরেছেন।

এ প্রসঙ্গে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ইমাম রহমান ও আসমা খাবারের সঙ্গে টিকটিকি ও জামালগোটা ফল মিশিয়ে আজহারুলকে খাওয়ার পরিকল্পনা করেন। আব্দুর রহমান চারটি টিকটিকি ও কিছু জামালগোটা ফল দিয়ে ভর্তা তৈরি করেন। পরে তা আসমার বাসায় দিয়ে আসেন। তাকে বলে আসেন, আজহারুল বাসায় এলে যেন অন্য খাবারের সঙ্গে এ ভর্তি মিশিয়ে খেতে দেন। ওইদিন রাতে আজহারুলকে টিকটিকি ও জামালগোটা ফলের ভর্তা খাওয়ান আসমা।

এতে রাত সাড়ে ৯টা থেকে আজহারুলের পাতলা পায়খানা ও বমি শুরু হয়। রাত ১১টার দিকে আসমা ফোন করে আব্দুর রহমানকে বিষয়টি জানান। তখন ইমাম রহমান আসমাকে বলেন, কোনোভাবেই যেন আজহারুলকে হাসপাতালে না নেওয়া হয়। তার কথামতো আজহারুলকে বাড়িতে রেখে দেন আসমা। টানা দুই-তিনদিন বাসায় মূমুর্ষ অবস্থায় পড়ে থাকেন আজহারুল।

পরে অসুস্থতার বিষয়টি জানতে পারেন তার বন্ধু ও প্রতিবেশীরা। তারা আসমাকে চাপ দেন যেন তিনি আজহারুলকে হাসপাতালে নিয়ে যান। চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে আসমা তার স্বামীকে আজহারুলকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিছুটা সুস্থ হলে তারা বাসায় ফেরেন। এরপর আজহারুল তার স্ত্রী আসমা ও সন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ছুটিতে যান।

ছুটি শেষে ২০২১ সালের ১৮ মে আজহারুল স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামে রেখে একাই ঢাকায় ফেরেন। গ্রাম থেকে আসমা ইমাম আব্দুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাকে নির্দেশ দেন যেন দ্রুত আজহারুলকে হত্যা করা হয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী- ২০২১ সালের ২০ মে রাতে ইমাম আব্দুর রহমান মসজিদে তার কক্ষে রাতের খাবার খেতে আজহারুলকে দাওয়াত দেন। তবে তিনি যেতে রাজি ছিলেন না। পরে স্ত্রী আসমা আজহারুলের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে সেখানে যেতে রাজি করান।

আজহারুল ওইদিন রাতে সরদারবাড়ি জামে মসজিদে এশার নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে মসজিদের দোতলায় ইমাম আব্দুর রহমানের কক্ষে যান। সেখানে যাওয়ার পর প্রথমেই আব্দুর রহমান আজহারুলকে ডাবের পানি খাওয়ান। তাতে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। ফলে ডাবের পানি খাওয়ার কিছুক্ষণ পর আজহারুল ঘুমিয়ে পড়েন। কক্ষে তালা দিয়ে এক-দেড় ঘণ্টা বাইরে ঘুরে বেড়ান ইমাম আব্দুর রহমান।

রাত বাড়তে থাকে। চারদিকে মানুষের চলাফেরা কমে যায়। রাত ১১টার পরে কক্ষে ফেরেন ইমাম রহমান। সেখানে গিয়েই আজহারুলকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। উঠেই আজহারুল বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য বের হতে যান। এসময় তাকে জাপটে ধরে কক্ষের মেঝেতে ফেলে দেন রহমান। এরপর তার ঘাড়ে ধারালো চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকেন। এতে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলে আজহারুল মারা যান।

আজহারুলকে হত্যার পর তার মরদেহ টেনেহিঁচড়ে বাথরুমে নিয়ে যান। এরপর কক্ষের মেঝের রক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন তিনি। মোবাইলে কথা বলেন আসমার সঙ্গে। আসমা তাকে মরদেহ গুম করার পরামর্শ দেন। রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত চাপাতি, ধারালো ছোরা, চাকু দিয়ে আজহারুলের মাথা, হাত-পা কেটে ছয় খণ্ড করেন। সেগুলো বস্তায় পুরে মসজিদের সেপটিক ট্যাংকিতে ফেলে দেন।

যেভাবে মরদেহ উদ্ধার ও রহস্য উদঘাটন
২০২১ সালের ১৯ মে গ্রামের বাড়ি থেকে আসার পর আর কোনো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা হয়নি আজহারুলের। পরদিন তিনি নৃশংস হত্যার শিকার হন। তার মরদেহ ফেলা হয় সেপটিক ট্যাংকিতে। ফলে কোনো হদিস মিলছিল না আজহারুলের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছে তার আত্মীয়-স্বজনরা অভিযোগ করলে অনুসন্ধান শুরু হয়। ২৪ মে মসজিদের সিঁড়িতে রক্তের দাগ দেখা যায়। সেপটিক ট্যাংক থেকেও দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। সন্দেহের তীর যায় ইমামের দিকে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইমাম আব্দুর রহমানকে আটক করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা হয়। উদ্ধার করা হয় খণ্ড খণ্ড মরদেহ। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতি, ধারালো ছোরা ও চাকু উদ্ধার এবং ইমামের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। পরে ২৬ মে নিহতের ভাই হাসান বাদী হয়ে দক্ষিণখান থানায় দুজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। আসামি আব্দুর রহমানের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার শ্রীরামকান্দি গ্রামে এবং আসমা আক্তারের বাড়ি টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কুইজবাড়ি গ্রামে।

আরও খবর