সুরা আল মু’মিনুন (বিষয়বস্তু, নামকরণ, প্রেক্ষাপট,শানে নুযূল)

নামকরনঃ

সুরার নামকরন দুই ভাবে হয়ে থাকে- বহুল আলোচিত শব্দ (শব্দ ভিত্তিক). যেমন- নাস, ফালাক বিষয়ভিত্তিকঃ যেমন- সুরা ফাতেহা, ইখলাস এ সুরাটি ১ম আয়াতের আল মুমিনুন শব্দ থেকে নামকরন করা হয়েছে।

নাযিল হবার সময়কাল ও মূল বিষয়বস্তুঃ সুরাটি মক্কী, হিজরতের পূর্বে নাজিল হয়েছে। তবে ঠিক কোন সময়ে নাজিল হয়েছে তা সঠিক ভাবে বলা য়ায় না। বর্ণনাভঙ্গি ও বিষয়বস্তু হতে প্রতিয়মান হয় যে, এ সুরা রাসুল করীম (সঃ) এর মক্কী জীবনের মাঝামাঝি সময়ে নাজিল হয়েছিল। এ সুরার মুল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে রসুলের আনুগত্য করার আহ্বান। সুরার প্রথমে এ আলোচনা করা হয়েছে যে, নবীর অনুসারী মুমিনদের কতিপয় গুনাবলী রয়েছে, এই বিশেষ গুণাবলী অর্জনকারীরাই সফলকাম। ইহকালে ও পরকালে তারাই সাফল্য লাভকরবে। পরে এ সুরায় মানব সৃষ্টির বিভিন্ন স্তরের কথা আলোচনা করা হয়েছে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম তিনি তোমাদেরকে পরকালে তার সামনে হাজির করতেও সক্ষম। তিনি তোমাদের হিসাব-কিতাব নিবেন। এ সুরায় আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তেমনিভাবে বিভিন্ন উম্মতের কথা উল্লেখ করে তাদের পরিনতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যেন দুনিয়াবাসী নবী করীম (সঃ) এর আনুগত্য করে, আল্লার বিধানকে মেনে নেয়, তারই ইবাদত করে। আল্লাহর ও তার রসুলের আনুগত্য না করলে কেউ মুক্তি পাবে না এসব বিষয়গুলিই এ সুরায় আলোচনা করা হয়েছে।

সুরা আল মুমিনুনের ফজিলতঃ

হযরত উমর (রাঃ) বলেন রসুল (সঃ) এর প্রতি যখন অহি নাজিল হত তখন মৌমাছির গুঞ্জনের ন্যায় আওয়াজ শুনা যেত। একদিন তাঁর কাছে এমনি আওয়াজ শুনে আমরা অহি শুনার জন্য থেমে গেলাম। অহির বিশেষ এ অবস্থার শেষ হলে নবী করীম (সঃ) কেবলামুখী হয়ে বসে পড়লেন এবং দোয়া, করতে লাগলেন اَللّهُمَّ زِدْنَا وَلَا تَنْقُصْنَا وَأَكْرِمْنَا وَلَا تُهِنَّا وَأَعْطِنَا وَلَا تَحْرِمْنَا وَآثِرْنَا وَلَا تُؤْثِرْ عَلَيْنَا وَاَرْضِنَا وَارْضَ عَنَّا “হে আল্লাহ! আমাদেরকে বেশী দাও কম দিওনা। আমাদের সম্মান বৃদ্ধি কর- লাঞ্ছিত করো না। আমাদেরকে দান কর-বঞ্চিত করো না। আমাদেরকে অন্যের উপর অধিকার দাও অন্যদেরকে আমাদের উপর অগ্রাধিকার দিয়ো না, আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাক এবং আমাদেরকে তোমার সন্তুষ্ট কর।”(তিরমিজি) এরপর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ এক্ষণে দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে। কেউ যদি এ আয়াতগুলো পুরোপুরি পালন করে, তবে সে সোজা জান্নাতে যাবে। এরপর তিনি সুরা মুমিনুনের প্রথম দশটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন। (আহমাদ) ইমাাম নাসায়ী তফসীর অধ্যায়ে ইয়াযিদ ইবনে কাবনুস বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) কে প্রশ্ন করা হয় যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর চরিত্র কিরূপ ছিল? তিনি বললেন তার চরিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে অতঃপর তিনি এই দশটি আয়াত তেলাওয়াত করে বললেনঃ এগুলোই ছিল রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর চরিত্র ও অভ্যাস। (ইবনে কাসীর)

শানে নুযূল/পটভূমিঃ

অত্র সুরা বিশেষ করে তেলাওয়াতকৃত আয়াতগুলো নাজিলের মক্কার কাফেররা যেমন ছিল ইসলামের চরম বিরোধী তেমনি পার্থিব উপকরণ সব ছিল তাদের হাতের মুঠোয় (বাণিজ্য)। অপরদিকে মুসলমানদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। (আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানগত) এই অবস্থায় কাফেররা নিজেদের অধিক সফল এবং মুসলমানদের ব্যর্থ মনে করত। তখন মুমিনদের প্রকৃত সফলতার ঘোষণা দিয়ে এ আয়াতগুলি নাজিল করেন। প্রকৃত সফলতার অর্থ ঃ তাফসীর কারকগণ ব্যাখ্যা করেছেন কোন একটি সুন্দর দালানে এক ব্যক্তি ৫দিন থাকতে পারবে এবং যদি কুড়েঘরে থাকে তবে সারাজীবন থাকতে পারবে- এক্ষেত্রে একজন বুদ্ধিমান কোনটি বেছে নেবে। অথচ আখেরাতে চিরজীবনের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা আছে।

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাঃ
অর্থঃ নিশ্চিত ভাবে সফলকাম হয়েছে মুমিনরা। এখানে মুমিন বলতে তারা যারা রাসূল (সা:) এর উপর ঈমান এনে তার আনীত বিধান মেনে নিয়েছে এবং তার দেখানো জীবনপদ্ধতি অনুসরন করেছে। “নিশ্চিতভাবেই সফলতা লাভ।” দিয়ে বাক্য শুরু করার তাৎপর্য বুঝতে হলে নাজিলের পরিবেশকে সম্মুখে রাখা দরকার। কাফিরদের ইসলাম বিরোধীতা। সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি। মুসলমানদের সামাজিক ও আর্থিক পশ্চাতপদতা। আল্লাহ যখন এই মুসলমানদেরই সফল বললেন তখন বোঝা যায় আল্লাহর নিকট সফলতার মানদন্ড ঈমান অর্থ নয়। প্রকৃত সাফল্য আখেরাত। (পূর্ব দ্রষ্টব্য) আল কোরআনে সাফল্যঃ ব্যবস্থা-পত্র অর্থঃ যে নিজেকে পাপ থেকে পবিত্র রেখেছে সেই সফল। সফলতা লাভের জায়গা আখেরাত- بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا (১৬) وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى (১৭) অর্থাৎ (হে মানুষ) তোমরা দুনিয়াকেই পরকালের উপর অগ্রাধিকার দিচ্ছ। অথচ দুনিয়ার তুলনায় আখেরাতের জীবন অতি উত্তম এবং স্থায়ী। (সুরা আ’লা: ১৬,১৭) আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ তায়লা সেসব মুমিনকে সাফল্য দান করার ওয়াদা করেছেন। যারা আয়াতে উল্লিখিত সাতটি গুনে গুনান্বিত। পরকালের পূর্ণাঙ্গ সাফল্য এবং দুনিয়ার সম্ভাব্য সাফল্য সবই এই ওয়াদার অন্তর্ভুক্ত। মুমিনদের সাতটি গুনঃ সর্বপ্রথম গুন হলো ঈমানদার হওয়া। কিন্তু এটা একটা বুনিয়াদী ও মৌলিক বিষয় বিধায় এটাকে এই সাতটি গুনের মধ্যে শামিল না করে পর পর সাতটি গুন বর্ণনা করা হয়েছে।

শিক্ষাঃ

১। সফলতা নিছক ঈমানের ঘোষনা অথবা নিছক সৎ চরিত্র ও সৎকাজের ফল নয়। বরং উভয়ের সম্মিলনের ফল।

২। নিছক পার্থিব ও বৈষয়িক প্রাচুর্য ও সম্পদশালীতা এবং সীমিত সাফল্যের নাম সফলতা নয়। আখেরাতের স্থায়ী সাফল্যই প্রকৃত সাফল্য।

৩। খুশু খুযুর সাথে নামায আদায়।

৪। বাজে কথাও কাজে সময় নষ্ট না করা

৫। সর্ববস্থায় নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে সচেষ্ট হওয়া।

৬। অবৈধ পন্থায় কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার চিন্তাও না করা।

৭। আমানতের হেফাজত করা এবং অঙ্গীকার বা ওয়াদা যথাযথভাবে পালন করা।

৮। নামাযে পাবন্দী করা এবং প্রত্যেক নামায মোস্তাহব ওয়াক্তে আদায় করা।

আরও খবর