আবদুল্লাহ আল মামুন, যুগান্তর •
আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনে সরকার ও দলের নেতৃত্ব আলাদা করতে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গণভবনসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকার ও দলের নেতৃত্ব আলাদা করার প্রক্রিয়া গত দুই সম্মেলন থেকেই শুরু হয়েছে। এবার সাধারণ সম্পাদককে সার্বক্ষণিক সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত রাখার ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে একটি নজির গড়তে পারেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাইরে রাখা হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ পদধারী দলীয় নেতাদেরও।
নাম প্রকাশ না করে ক্ষমতাসীন দলটির নীতিনির্ধারকরা যুগান্তরকে বলেছেন, কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হয়ে দাপ্তরিক কাজ অর্থাৎ সরকার পরিচালনায় ব্যস্ত থাকায় আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু আগামী সংসদ নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তাই কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া নেতাদের সার্বক্ষণিক সাংগঠনিক কাজে মনোযোগের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তাদের মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই না দেওয়াই ভালো।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, গত সম্মেলনে মন্ত্রীদের দলীয় নেতৃত্বে রাখার রীতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে। এ কমিটিতে মন্ত্রীদের আধিক্য না থাকায় দল ও সরকার একে অপরের সহায়ক হয়েছে; কিন্তু একাকার হয়নি। এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, দলকে সরকার থেকে আলাদা করার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। তিনি বলেন, আমরা দল থেকে সরকারকে আলাদা করার নীতি নিয়েছি। দল দলের মতো চলবে, সরকার সরকারের মতো থাকবে। বর্তমান কমিটিতে যতটা সম্ভব এ নীতি বাস্তবায়িত হয়েছে। এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন এমন মাত্র পাঁচজন নেতা রয়েছেন মন্ত্রিপরিষদে। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া সৌভাগ্যবান অন্য চার নেতা হলেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের (সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী), সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক (কৃষিমন্ত্রী) এবং যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি (শিক্ষামন্ত্রী) ও ড. হাছান মাহমুদ (তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী)। এবার তাদের কপালে কী থাকছে, তা দেখার বিষয়।
কাল শনিবার আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কে পাচ্ছেন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব? এই প্রশ্নটিই এখন সবার মুখে মুখে। নেতাকর্মীরা বলছেন, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক পদেই থেকে যাচ্ছেন বলে তারা শুনছেন।
তিনি যদি এবারও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান, তাহলে তার মন্ত্রিত্ব রাখা না রাখার বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নিতে হবে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। আর নতুন কেউ এলে তা মন্ত্রিপরিষদের বাইরের কেউ হবেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম ও দ্বিতীয় মেয়াদের (২০০৯-২০১৮) মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, নূরুল ইসলাম নাহিদ, আবদুল মান্নান খান, রমেশ চন্দ্র সেন, শাজাহান খান, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ছিলেন আওয়ামী লীগের গত কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। এই তিন তরুণ নেতার ঠাঁই হয়নি আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে।
আওয়ামী লীগে এর আগেও একবার দল ও সরকারের নেতৃত্ব আলাদা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দশম সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা দলীয় পদে থাকতে পারবেন না সিদ্ধান্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতির পদ ছেড়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রীকে দলীয় সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য গত দুই সম্মেলনে কাউন্সিলরদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তার এ আহ্বানে সাড়া দেননি। সারা দেশের নেতাকর্মীরা মনে করেন, দলে শেখ হাসিনার বিকল্প এখনো গড়ে উঠেনি। সাংগঠনিক দক্ষতা আর মেধায় আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি, একই সঙ্গে হয়ে উঠেছেন নেতাকর্মীদের ঐক্যের প্রতীক।
আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি ও গত দুই কমিটির সময়কার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের আগের কমিটিতে সভাপতি, কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদ মিলে ২৩ নেতা মন্ত্রী, মন্ত্রী পদমর্যাদা, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী ছিলেন ১৪ জন দলীয় নেতা। সম্মেলন শেষে ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যাটি নেমে আসে পাঁচে। এছাড়াও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ছিলেন আইনবিষয়ক সম্পাদক। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ছিলেন অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক। তারা কেউই বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেই।
সেই ধারাবাহিকতার ছাপ এবারের জাতীয় সম্মেলনেও পড়তে পারে বলে নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। আগামীকাল শনিবার অনুষ্ঠেয় দলের সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না হলেও সরকার থেকে দলকে আলাদা করার জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই উদ্যোগ সরকার ও দলকে আলাদা করার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ দুটি বিষয়কে আলাদা করার জন্য এটাই একমাত্র পদ্ধতি নয়। দল সরকারকে দায়বদ্ধ করবে তার নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নে। কিন্তু যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান এক ব্যক্তি হবেন, তখন কে কাকে দায়বদ্ধ করবে?
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-