অমরেশ রায় •
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা বলছেন, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন দলটিকে সবার আগে নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকারগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। বিশেষ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনমনে আস্থা বাড়াতে হবে।
তবে আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে শুধু এটিই যথেষ্ট হবে না- এমনটিও মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা। তাঁদের মতে, আওয়ামী লীগকে আরও অনেক লক্ষ্য পূরণ করতে হবে। যেমন- বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি বিরোধী মহল ও মানুষের ভেঙে পড়া বিশ্বাস ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। একই সঙ্গে সব দলকে আস্থায় এনে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের সামনে রয়েছে বৈশ্বিক মহামারি করোনা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা তথা অর্থনীতির চাপ সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। আছে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানার চাপও। অর্থনৈতিক সংকটের মুখে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বিশেষ করে সরকারের অগ্রাধিকারের মেগা প্রজেক্টগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার বড় চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এ ছাড়া দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা এবং সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর নেতাকর্মীকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু সমকালকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করে যেতে পারলেও কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দেওয়ার সময় পাননি। তাঁর সেই অসমাপ্ত কাজটি এখন বাস্তবায়ন করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত করবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাম্প্রতিক দলীয় সভা-সমাবেশে বলেছেন, আওয়ামী লীগ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আছে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই ক্ষমতায় থাকবে। জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগ আবারও রাষ্ট্র পরিচালনায় এসে দেশকে উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের সংগ্রামে জয় হবেই।
সুশাসন প্রসঙ্গ :একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের বিশেষ অঙ্গীকারের তিনটি প্রধান দিক ছিল ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ’, ‘সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল’ এবং ‘গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা’। অর্থাৎ সুশাসন প্রতিষ্ঠাই ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য।
এই অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্য নিয়ে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে দুর্নীতি ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অভিযানকালে ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের অনেক প্রভাবশালী শীর্ষ নেতা ও জনপ্রতিনিধিকে গ্রেপ্তারসহ কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে প্রশংসিতও হন তিনি। পাশাপাশি জঙ্গি, মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ ঘোষণা ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশে সুশাসন তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও ছিল সরকারের।
কিন্তু পরের বছরই করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের সীমাহীন দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। মাস্ক ও পিপিই ক্রয়, সরবরাহ এবং করোনা পরীক্ষা নিয়ে কেলেঙ্কারি সরকারকে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। করোনা শেষেও দুর্নীতি-লুটপাটের এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি-লুটপাট ও অর্থ পাচারে অর্থনীতিতে চাপ পড়ছে- এমনটাও মনে করেন অনেক অর্থনীতিবিদ।
অন্যদিকে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য একটি জনগোষ্ঠী ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নিপীড়ন-নির্যাতনেও থেমে নেই। গত বছরের অক্টোবরে দুর্গাপূজায় হিন্দুদের পূজামণ্ডপ ও বাড়িঘরে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক হামলা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। এ বছরের দুর্গাপূজার শুরুতেও এমন সাম্প্রদায়িক হামলা-নির্যাতনের অপচেষ্টা দেখা গেছে। সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও সমাজে পরিপূর্ণ আস্থা অনুপস্থিত।
আইনশৃঙ্খলা, মানবাধিকার :একই সঙ্গে দেশজুড়ে সন্ত্রাস-সহিংসতা, খুন-জখমসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে জনজীবনে সংকট নেমেছে। নারী নির্যাতন ও দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রবণতা বেড়েছে। ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টার তথা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই চাপের মুখে ফেলে দেয় সরকারকে। এরপর গত কয়েক মাস বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা লোপ পেয়েছে। তার পরও বিভিন্ন স্থানে গুম-খুনের অভিযোগ নিয়ে দেশের মধ্যে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো যেমন সমালোচনামুখর রয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রশ্নে সরকারের ভাবমূর্তি অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ইশতেহার অনুযায়ী দুর্নীতি ও মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষুষ্ণতা’ নীতির সঠিক বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করে আগামী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার লক্ষ্য পূরণের পথে অগ্রসর হতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শুধু সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলেই চলবে না; একই সঙ্গে দল ও দেশকে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন এবং দুঃশাসন থেকে বের করে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। জঙ্গিবাদের উত্থান মোকাবিলা করে শান্তিপূর্ণভাবে দেশ পরিচালনার উপায়ও খুঁজতে হবে। আর এর সবই বাস্তবায়নের দায়ভার আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের ওপরই বর্তায়।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। জঙ্গি-সন্ত্রাস মোকাবিলা এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেতনা ধারণ করে উন্নত ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার চ্যালেঞ্জ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই বাস্তবায়ন করবে।
নির্বাচন ব্যবস্থায় আস্থা ফেরানো :গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধের নজিরবিহীন সিদ্ধান্তে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, ইভিএমে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা কেন্দ্রে কেন্দ্রে দখল ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। তাই ঢাকা থেকে সিসিটিভিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর নির্বাচন বন্ধের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনের ইতিহাসের নজিরবিহীন এমন ঘটনা আওয়ামী লীগ ও তার সরকারকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ‘বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে, বিশেষ করে ইভিএমে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না’- বিরোধী দলের পাশাপাশি জনমনেও এমন বিশ্বাস দৃঢ় হয় কিনা, সেই প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। আগে থেকেই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচন নিয়ে সর্বমহলে কঠিন প্রশ্ন ছিল। পরবর্তী সময়ে উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েও এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক গাইবান্ধা উপনির্বাচনের ঘটনাপ্রবাহ জনমনের সেই আস্থাহীনতাকে আরও জোরালো করেছে।
প্রশাসনের নিরপেক্ষতা :ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনকালীন প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখাও সরকারের আরেকটি চ্যালেঞ্জ। যদিও নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে সচিব, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসন ও পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ‘রহস্যজনক’ সরকারি সিদ্ধান্তে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। এ নিয়ে সরকার ও প্রশাসনের অন্দরমহলেও নানা কানাঘুষা চলছে।
অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও আইনের শাসন সুনিশ্চিত করাও আওয়ামী লীগের সামনের দিনের চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক মহল ও জনমনে আস্থা ফেরানোর কাজে সবার আগে মনোযোগী হতে হবে সরকারকে।
বিরোধী দলের আন্দোলন :বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি আওয়ামী লীগকে অস্বস্তিতে ঠেলে দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বিএনপির কর্মসূচিতে সরকার সমর্থক ও পুলিশের হামলা-মামলা ও নির্যাতনের পর গণপরিবহনে এক ধরনের পাতানো ধর্মঘট ডাকিয়ে ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর ও বরিশালের বিভাগীয় গণসমাবেশে বাধা দিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য তীব্র দুর্ভোগ সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে। আবার বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও বিএনপির এসব গণসমাবেশে বিশাল জনসমাগম ক্ষমতাসীনদের কিছুটা হলেও শঙ্কিত করেছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে ‘সরকার পতন’ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবি আদায়ের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বিএনপি। যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পাল্টা কর্মসূচি ও শোডাউনের মাধ্যমে রাজপথে শক্তি পরীক্ষার প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকে রাজপথ দখলে রেখে বিএনপিকে প্রতিহত করার পাল্টা হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন :বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশন তথা ইভিএমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়েও বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ঘোরতর আপত্তি। এ অবস্থায় বিএনপিসহ সব দলকে নির্বাচনে এনে অংশগ্রহণমূলক ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া এবং এর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি মহলে সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করাও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অতীতে দেশের সাতটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। সেগুলোসহ গাইবান্ধা উপনির্বাচন থেকে এটা সুস্পষ্ট, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। এখন রাজনীতিবিদদের, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, গণতন্ত্রকে মাথায় রেখে আওয়ামী লীগ সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই কাজ করে, এগিয়ে যায়। কাজেই জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে যা যা পদক্ষেপ প্রয়োজন- তার সবই নেবে আওয়ামী লীগ।
অর্থনীতির চাপ সামাল :আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গত দুই বছরের করোনা সংকট বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রশংসায় সিক্ত হচ্ছিল। কিন্তু করোনার প্রভাব কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বড় ধাক্কা দিয়েছে; দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে কাবু করে ফেলেছে।
অর্থনীতির এমন সংকটের মুহূর্তে দেশে প্রবৃদ্ধি কমে ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট সংকটের আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেটা রেকর্ড ৮ শতাংশ অতিক্রম করেছিল। মূল্যস্ম্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২ শতাংশে। করোনার আগেও যেটা ছিল ৬ শতাংশের নিচে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমে প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। করোনার মধ্যে গত বছরের আগস্টেও রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবাসী রেমিট্যান্স কিছুটা বাড়লেও সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে কমেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে গত আগস্টে ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎসহ খাদ্য ও সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং পরিবহন ভাড়া কয়েক গুণ বেড়েছে। এমনতিইে করোনার মধ্যে কর্মহীনতা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির সংকটে মানুষ জর্জরিত ছিল। এর ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সংকটে মানুষের নাভিশ্বাস। করোনার কারণে নতুন করে দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে। গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এলএনজি আমদানি প্রায় বন্ধ। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎসহ শিল্পকারখানার উৎপাদন টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর। ফলে শতভাগ বিদ্যুতের সুবিধা নিশ্চিত হওয়া দেশে এখন রোস্টার করে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এই সরকারের প্রথম মেয়াদ থেকে নেওয়া বিদ্যুতের কুইক রেন্টাল প্রকল্প এবং তাতে সীমাহীন দুর্নীতি-লুটপাট ও অপচয়ের অভিযোগ অনেকটা ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে মেরামত করে দেশকে এগিয়ে নেওয়াটাই আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের এই মুহূর্তের লক্ষ্য হতে হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ বলেন, টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের এখনকার লক্ষ্য, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা থেকে জনগণকে কীভাবে স্বস্তিতে ফিরিয়ে আনা যায়। মানুষকে দুর্যোগ ও সংকট থেকে মুক্ত করে দেশকে ভালোভাবে এগিয়ে নেওয়াটাই এখন আওয়ামী লীগের প্রধান কাজ। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছেন তাঁরা।
উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া :অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রায় থমকে যেতে বসেছে। এরই মধ্যে ছোট-বড় কয়েকশ উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত রাখতে বা কাটছাঁট করতে হয়েছে। সরকারি অগ্রাধিকারের মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ ধীরগতিতে চললেও বরাদ্দ কমাতে হয়েছে। ফলে নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতিতে যতটা আশার সঞ্চার করেছিল, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট আওয়ামী লীগ ও তার সরকারকে ততটাই হতাশ করে তুলেছে। আর এতসব সংকটের কারণে ‘সংকট মোকাবিলার প্রতীক’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পর্যন্ত প্রতিনিয়ত দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা ব্যক্ত করতে হচ্ছে। দেশবাসীকে সাশ্রয়ী ও মিতব্যয়ী হওয়ার পাশাপাশি সঞ্চয় ও খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতিতে সৃষ্ট এই ক্ষত সহসা মিটবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে এই চ্যালেঞ্জ উত্তরণেও সরকারকে বেশ বেগ পেতে হবে।
অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, চলমান অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা এবং জনজীবনের সব সংকট নিরসনের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফেরানোর এই চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগকেই পূরণ করতে হবে। এককথায়, বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে জনজীবনে স্বস্তি ও শান্তি আনয়নের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি আগামী নির্বাচনেও জয়ের ধারা ধরে রাখতে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সম্ভব সব ধরনের উপায় খুঁজে নিয়ে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারকে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও এ থেকে উত্তরণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার যথেষ্ট তৎপর। অচিরেই এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে। শিগগির সব সংকট কেটে গিয়ে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে।
দলীয় শৃঙ্খলা :করোনা পরিস্থিতিসহ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল ও অনুপ্রবেশ, তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্বের দুর্নীতি-অনিয়ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া এবং টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার অহংবোধসহ নানা কারণে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এক ধরনের স্থবিরতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দলকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। বিতর্কিত ও অপরাধে যুক্ত নেতাকর্মীকে বাদ দিয়ে তাঁদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। দল ও সহযোগী সংগঠনের সর্বস্তরে নতুন সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার উপযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দল গোছানোর প্রক্রিয়া অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। মাঝখানে করোনা পরিস্থিতি রাজনৈতিক অঙ্গনেও স্থবিরতা এনে দেওয়ায় এ প্রক্রিয়া কিছুটা থমকে যায়। তবে করোনার মধ্যেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসনের মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করে তোলা, তৃণমূল সম্মেলন ও কমিটি গঠন, সদস্য সংগ্রহ এবং দলকে অনুপ্রবেশমুক্ত করার মাধ্যমে ত্যাগী ও স্বচ্ছ ইমেজের নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ইত্যকার কাজগুলো কমবেশি এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। করোনার মধ্যেই চলেছে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত দলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ- উভয় অংশের ওয়ার্ড ও ইউনিট সম্মেলন, নতুন কমিটি গঠন এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমের কাজ। অনেক জেলা-উপজেলায়ও একই কার্যক্রম চলেছে সমানতালে। করোনা শেষে দল গোছানোর এই কার্যক্রম আরও বেড়েছে। চলমান রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-উপজেলা সম্মেলনগুলো। করোনার আগে ও পরে মিলিয়ে দলের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৪৮টি জেলা সম্মেলন শেষ করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ৩০টি জেলা সম্মেলন কার্যক্রম জোরেশোরে চলছে, যা আগামী ডিসেম্বরে দলের জাতীয় কাউন্সিলের আগেই শেষ করা যাবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-