কক্সবাজার উপকূল থেকে অবৈধভাবে মানব পাচারে সমুদ্রে মৃত্যুর হাতছানি

বিশেষ প্রতিবেদক :

ফাইল ছবি

কনকনে শীত। শান্ত সমুদ্র। নোনাজলের ছোট ছোট ঢেউ ভেঙে বয়ে চলেছে ইঞ্জিনচালিত ফিশিং বোট। নীল জলের এ ছন্দ, প্রকৃতির মনোরম দৃশ্যেও ভাবলেশহীন বছর ত্রিশের যুবক আবুল হাসান। নানা বয়সী আরো ৪৫ জন তার সঙ্গী। সবাই যাত্রা করেছেন মালয়েশিয়ার পথে। দালালের সঙ্গে তাদের জনপ্রতি চুক্তি ২ লাখ টাকার। কক্সবাজার উপকূল থেকে যাত্রা করে উখিয়া ও মিয়ানমার হয়ে পৌঁছে দেবে মালয়েশিয়ার রানং শহরে।

এরপর জীবনটাকে নিজের মতো করেই সাজাবেন। ঘুচিয়ে দেবেন সব ঋণ। দরিদ্রতাকে ছুড়ে ফেলে কাটাবেন সুখের সময়। এ স্বপ্ন বুনতে বুনতে স্নিগ্ধ হাওয়ায় চোখটা বুজে এসেছিল আবুল হাসানের। হঠাৎই ডুবে যায় তাদের নৌকাটি। ভেসে যান একটি চরে। এরপর সংজ্ঞা হারান। দীর্ঘ সময় পর বাঁশির শব্দে তার চেতন ফেরে। চোখ খুলে দেখেন হ্যান্ডমাইকে ডাকা হচ্ছে একটি নৌকায় ওঠার জন্য। বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের তত্পরতায় এবেলা সবাই উদ্ধার হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও অধিকাংশের কপালেই জোটে ক্ষুধা, নির্যাতন এমনকি মৃত্যুও।

অবৈধভাবে সড়কপথে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার রুটটি মূলত ঢাকায় শুরু। এরপর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত হয়ে মিয়ানমারের মান্দালয়। সেখান থেকে থাইল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে মালয়েশিয়ার রানং শহরে পৌঁছতে হয়। আর এ যাত্রায় একদিকে যেমন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বাধা, অন্যদিকে আছে দেশগুলোর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্পরতা। তবে সড়কপথের এ রুটটির জন্য এখন সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মিয়ানমারের সংঘাতপূর্ণ অবস্থা। তাই এসব বিষয় বিবেচনায় মানব পাচারকারীদের কাছে গত কয়েক বছর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাত্রা।

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। ১২০ কিলোমিটার উপকূলে ঘেরা এ শহরটি থেকে সমুদ্রের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ। সাগরের বুকে তাকালেই চোখে পড়বে অসংখ্য ডিঙি নৌকা। এসব ডিঙি নৌকার পয়েন্টগুলোই মূলত মানব পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উপকূল থেকে এসব নৌকায় করে বিদেশ যেতে লোকজনকে তুলে দেয়া হয় মাঝসাগরে থাকা বড় ফিশিং বোটে। যাদের গন্তব্য মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ড।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশ দুটিতে যেতে কয়েক বছর ধরে কক্সবাজার, উখিয়া, মহেশখালী হয়ে মিয়ানমারের মান্দালয়, থাইল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে মালয়েশিয়ার রানং রুটটির ব্যবহার বেড়েছে। এ রুটের বাঁকে বাঁকেই মানব পাচারকারীদের বিচরণ। শীতকালে শান্ত সমুদ্রে শুরু হয় অবৈধ এ যাত্রা। ফলে কনকনে শীতে ছোট বোটে দীর্ঘ এপথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই প্রাণ হারান। আর যারা বেঁচে যান, তাদের লড়াই করতে হয় ক্ষুধা, নির্যাতন আর নির্মমতার সঙ্গে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিককালে টেকনাফ ও কক্সবাজারের নাজিরারটেক, কস্তুরা ঘাট, উখিয়ার মনখালী, সোনারপাড়া, টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালী, জাহাজপুরা, টেকনাফ সদর, শাহপরীর দ্বীপ, ঘোলাপাড়া, পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়া, জেটিঘাট, কাটাবনিয়া, মিঠাপানির ছড়া, রাজার ছড়াসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রা বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে শুধু কক্সবাজারে ২ হাজার ৭৩৩ জনকে উদ্ধারের পাশাপাশি ১ হাজার ৩৫৫ জনের বিরুদ্ধে ২৪২টি মামলা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর (সিএমপি) ১৬টি থানায় ৮৫৮ জনকে উদ্ধারের পাশাপাশি ১৬৭ জনের বিরুদ্ধে করা হয়েছে ২৯টি মামলা।

মানব পাচার প্রতিরোধে সর্বাত্মকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস উইংয়ের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মনজুর রহমান। তিনি বলেন, মানব পাচার রোধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। সে অনুযায়ী নিয়মিত মানব পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি শীতকেন্দ্রিক সমুদ্রপথের অবৈধ যাত্রা ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতি রয়েছে। সমন্বিতভাবে কাজ করে এটি রোধ করা সম্ভব হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি) এবং বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত এক গবেষণায়ও মানব পাচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা সমুদ্রপথের এ রুটটির তথ্য উঠে এসেছে। মানব পাচার নিয়ে এটিই জাতীয় পর্যায়ের প্রথম গবেষণা, যেখানে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে বিদেশ যাত্রায় সর্বাধিক ব্যবহূত তিনটি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ নম্বর রুট দিয়ে কক্সবাজার থেকে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড নেয়া হয় লোকজনকে। আর অবৈধ এ পথে মানব পাচারকারীদের সারা দেশেই রয়েছে প্রচুর দালাল।

তারা বিভিন্ন প্রলোভনে ভুক্তভোগীদের প্রথমে কক্সবাজার নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে ডিঙিতে করে নেয়া হয় মহেশখালী। সমুদ্রপথে অবৈধ যাত্রার জন্য সেখানেই ফিশিং বোট অপেক্ষায় থাকে। সে বোটে চেপেই শুরু হয় অনিশ্চয়তার যাত্রা। নৌকাটি উখিয়া দিয়ে মিয়ানমারের উপকূলীয় শহর মান্দালয় হয়ে আন্দামান সাগরে প্রবেশ করে। সেখান থেকে প্রথমে যায় থাইল্যান্ড সীমান্তে। সেখানে দালাল চক্রের কিছু সদস্য থাকে। তারা থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়া সীমান্ত পারাপার করতে জনপ্রতি নেয় ৭০-৮০ হাজার টাকা।

তবে সাত দিন ও সাত রাতের এ সমুদ্রযাত্রায় কখনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কখনো আবার অপহরণকারী চক্রকে সামাল দিতে হয়, সেই সঙ্গে সমুদ্রের ঢেউ, তীব্র শীত ও খাবার সংকট তো আছেই।

যৌথভাবে পরিচালিত এ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে মানব পাচার প্রবণতায় মধ্যম পর্যায়ের ঝুঁকিতে রয়েছে কক্সবাজার। এ জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি অবৈধপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। বাহরাইনের (২৭ শতাংশ) পর সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসী দেশ দুটিতে রয়েছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড। বর্তমানে বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসীর ১৭ শতাংশই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটিতে। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে মালয়েশিয়া (১৫ শতাংশ)।

ভুক্তভোগীরা জানান, সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার জন্য প্রতিজনের কাছ থেকে প্রথম ধাপে নেয়া হয় ৩০-৫০ হাজার টাকা। আর এ কাজের জন্য তারা স্থানীয়ভাবে খোঁজ করে বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা মানব পাচারকারীদের, যাদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রামের অনেক ট্রাভেল প্রতিষ্ঠানের। কেউ যদি এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেতে চান, তাহলে তারা টেকনাফে স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়।

এছাড়া কক্সবাজার, মহেশখালী, উখিয়া, মিয়ানমারের মান্দালয়, থাইল্যান্ড সীমান্ত এবং রানং শহরের বেশ কয়েকটি দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালী ও মিয়ানমারের মান্দালয় শহরে দালাল চক্রের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।

সমুদ্রের উপকূলে মানব পাচার রোধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। বাহিনীর টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. আশিক আহমেদ নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, কক্সবাজার থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে সমুদ্রপথে অবৈধ যাত্রা করা একটি ট্রলার গত অক্টোবরের প্রথমদিকে টেকনাফের বাহারছড়া হলবনিয়া এলাকায় ডুবে যায়। পরে সেখান থেকে তিনজনের মৃতদেহ এবং ৪৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে তারা কক্সবাজার মহেশখালী থেকে মালয়েশিয়ার রানং শহরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। মূলত শীতে সমুদ্র শান্ত হয়ে এলে এ রুটটিতে মানব পাচারের প্রবণতা বেড়ে যায়। এজন্য নাফ নদীতে কোস্টগার্ডের দুটি বড় জাহাজ সার্বক্ষণিক রাখা হয়। এছাড়া মেরিন ড্রাইভ এলাকায়ও নিয়মিত টহল পরিচালনা করা হয়। এছাড়া স্থানীয় মানব পাচারকারীদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সমুদ্রে মানব পাচার রোধে সর্বাত্মক সচেষ্ট রয়েছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড।

কক্সবাজারের একটি শীর্ষ মানব পাচারকারী চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে একরামুল হক জুয়েল, যিনি একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য। তার নেতৃত্ব গড়ে ওঠা চক্রটি ২০১২ সাল থেকে কক্সবাজার, মহেশখালী ও উখিয়ার মানব পাচারের রুটটি নিয়ন্ত্রণ করছে। এ পর্যন্ত তারা কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও বাংলাদেশী নাগরিককে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে। এবারের শীত মৌসুমকে সামনে রেখে রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক মানব পাচার চক্র সক্রিয় হয়েছে বলে অভিযোগ। তারা এলাকাভিত্তিক টিম গঠন করে রোহিঙ্গাদের নানা প্রলোভন দিয়ে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। পরে তাদের সাগরে কিংবা জঙ্গলে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে আদায় করা হয় মোটা অংকের টাকা।

টেকনাফ উপজেলা মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির সদস্য ও হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, বেশ কয়েকটি চক্র সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। তারা সবাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংশ্লিষ্ট। আর অবৈধভাবে যারা মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সমুদ্রপথে যাত্রা করছে, তাদেরও সিংহভাগ রোহিঙ্গা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শক্ত ভূমিকা পালনের মাধ্যমে এ ধরনের মানব পাচারকারী চক্রের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে বলেও পরামর্শ দেন তিনি।

এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মানব পাচারকারী চক্রের বিষয়ে যখনই আমরা তথ্য পাচ্ছি অভিযান চালাচ্ছি। র্যাবের সব ব্যাটালিয়ন তত্পর। সীমান্তের দায়িত্বে থাকা বিজিবি ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমরা মানব পাচারবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

আরও খবর