দৈনিক বাংলা •
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মুসলিম এইডের বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ পুরোনো। ২০১৭ সালে মুসলিম এইডকে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার।
এবার সেই মুসলিম এইডের অনুদানের প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা কক্সবাজারের স্থানীয় এক এনজিওর মাধ্যমে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ উঠেছে।
চট্টগ্রামের এনজিওটির নাম ওয়াইপিএসএ (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন) বা ইপসা। এনজিওটি দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার এলাকায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিআইএফইউ) এক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি।
সিআইডির ইকোনমিক ক্রাইম স্কোয়াডের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করছি। বিষয়টি এখনো অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। এখনই এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মুসলিম এইডের অন্যতম একজন ট্রাস্টি হলেন চৌধুরী মইন উদ্দীন। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর নেতা হিসেবে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলে রেড নোটিশও জারি করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলাধীন মহাদেবপুর গ্রামের কয়েকটি যুব সংগঠন উন্নয়ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য ১৯৮৫ সালের ২০ মে ইয়ং পাওয়ার নামে সংগঠন তৈরি করে।
পরবর্তী সময় ১৯৯২ সালে নাম পরিবর্তন করে ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) নামে বেসরকারি অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সমাজ উন্নয়ন সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে সংস্থাটির ৬১টি শাখা ও ৫০টির বেশি প্রজেক্ট অফিস রয়েছে। সারা দেশে কার্যক্রম চালানোর কথা বলা হলেও সংস্থাটির প্রধান কার্যক্রম কক্সবাজারভিত্তিক। রোহিঙ্গা পুনর্বাসন, খাদ্যসহায়তাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে।
সূত্র জানায়, ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইসলামিক এনজিও মুসলিম এইড থেকে এক কোটি ১২ লাখ টাকা অনুদান নেয় ইপসা। মুসলিম এইড থেকে টাকা আসার পরপরই স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের কক্সবাজার শাখায় ইপসার নামে পরিচলিত দুটি চলতি হিসাবে এই অনুদান স্থানান্তর করা হয়।
গত বছরের ৫ মে, ২৯ জুন ও ৬ অক্টোবর ইপসার একটি চলতি হিসাবে ৫৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং ১২ আগস্ট ও ১০ অক্টোবরে ইপসার আরেকটি চলতি হিসাবে ৫৩ লাখ ৬ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়। গত বছরের ১৩ এপ্রিল থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি হিসাব থেকে পুরো ৫৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা তুলে নেয়া হয়।
এর মধ্যে ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কক্সবাজার শাখায় পরিচালিত এসএম এন্টারপ্রাইজকে প্রদান করা হয়। এ ছাড়া ১০ লাখ টাকা চট্টগ্রামের চান্দগাঁও শাখায় ইপসার ফিন্যান্স ডিভিশন পরিচালিত এসএনডি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে এই অর্থ আবার এসএনডি হিসাব থেকে এস এম এন্টারপ্রাইজের চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে এস এম এন্টারপ্রাইজের হিসাব থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্কের মাধ্যমে নগদ, ট্রান্সফার ও ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সেই অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এস এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এস এম আতাউর রহমান। ব্যাংকের নথিপত্র অনুযায়ী ব্যবসার ধরন কন্ট্রাক্টর ও সরবরাহকারী হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। ইপসার অপর চলতি হিসাব থেকেও বাকি ৫৩ লাখ ৬ হাজার টাকা বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্কে নগদ, ট্রান্সফার ও ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে।
সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান, যার ট্রাস্টি একজন যুদ্ধাপরাধী, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও পলাতক আসামি, সমাজসেবার নামে কক্সবাজারের ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) কাছে অর্থ পাঠিয়েছে। এই অর্থ সন্ত্রাসে অর্থায়ন, মানব পাচার ও মাদক পাচারের মতো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর (রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির) পুনর্বাসনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও অর্থের গতিপথ বিবেচনায় তা সন্দেহজনক মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে।
এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসাত্মক ও জঙ্গি অর্থায়নে সহায়তার অভিযোগে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কোনো ধরনের সহায়তা করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর পরও বিতর্কিত ও নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের অনুদানের আড়ালে ধ্বংসাত্মক ও জঙ্গি অর্থায়নসহ দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের সংশ্লেষ থাকতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনজিওটি (ইপসা) বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অনুদান বাংলাদেশে আনয়ন করলেও তা দুস্থ ও মানবতার কল্যাণে ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে।
জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইপসার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি সিআইডির একটি দল আমাদের কাছে এসেছিল। আমরা তাদের সব ধরনের ডকুমেন্ট দিয়ে সহযোগিতা করেছি। আমরা এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর অনুমোদন নিয়েই এই অর্থ ছাড় করিয়েছিলাম। এ ছাড়া সেই অর্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবসন কমিশনারের কার্যালয়ের (আরআরআরসি) অনুমোদন নিয়েই মাঠপর্যায়ে খরচ করা হয়েছে। জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়নের যে অভিযোগটি উঠেছে তা সত্যি নয়।’
ইপসার একজন কর্মকর্তা জানান, মুসলিম এইড ইউকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে তারা এই অর্থ পেয়েছিলেন। ২০৩০ সাল পর্যন্ত মুসলিম এইডের রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগার পর সহায়তার জন্য বৈধ নিয়মেই অনুদানের আবেদন করা হয়েছিল।
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক শেখ মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি তো নতুন এসেছি। সুনির্দিষ্টভাবে মুসলিম এইডের বিষয়ে বলতে পারব না। তবে কিছু এনজিও আছে, তাদের কর্মকাণ্ড বিতর্কিত এবং তারা দেশবিরোধী কাজ করছে। এসব এনজিওর বিষয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি। ইতিমধ্যে কিছু এনজিওর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর প্রধান এ কর্মকর্তা বলেন, ‘মুসলিম এইড সম্পর্কে আমরা স্পেসিফিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করব। আমরা পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখব। যখনই আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাব, তখনই এসব এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-