বণিক বার্তা •
কক্সবাজার হাসপাতালে চারদিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছে রোহিঙ্গা যুবক আব্দুল্লাহ। সপ্তাহখানেক আগে তার গায়ে জ্বর আসে। ওষুধ খেয়েও না সারায় ভর্তি হয়েছিল উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) হাসপাতালে। এর মধ্যে শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়ায় তাকে সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা যায়, আব্দুল্লাহ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এ যুবক ধারণা করছে, ক্যাম্পে তার ঘরের পাশে থাকা ছড়ায় জমে থাকা পানিতে এডিস মশা আবাস গেড়েছে। সেখান থেকেই সে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আব্দুল্লাহর পাশের শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছে সতেরো বছরের রোহিঙ্গা কিশোর সৈয়দুল আমিন। শরীরে রক্তচাপ মাত্রাতিরিক্ত কমে যাওয়ায় তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।
দেশে এবারো ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। রাজধানীর বাইরে কক্সবাজারে এখন সংক্রমণ ও মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আর কক্সবাজারের মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই বেশি ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। ঢাকনা ছাড়া ব্যবহার্য পানি জমিয়ে রাখার প্রবণতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা দুর্বল হওয়ায় ঘিঞ্জি ক্যাম্পগুলোতে এডিস মশা বংশবিস্তার করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
একই সঙ্গে অতিমাত্রায় প্লাস্টিক ব্যবহারের কারণেও এসব বর্জ্যে দীর্ঘদিন পানি জমছে। তাতেও জন্ম নিচ্ছে মশা। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, কক্সবাজারে গত বুধবার পর্যন্ত ১৬ হাজার ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৪ হাজারই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। আর দেড় হাজার কক্সবাজারে বসবাসরত স্থানীয় বাংলাদেশী। মৃত্যুতেও এগিয়ে রয়েছে রোহিঙ্গারা। জেলায় ৩৩ জন ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ জনই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে রাখাইন থেকে পালিয়ে এসে ২০১৭ সালে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে। এ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকার, বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বর্তমানে কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের বসবাস করা ক্যাম্পগুলো ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাত্র ২০ বর্গফুটের ঘরে বাস করছে সাত থেকে আট রোহিঙ্গা। ঘরের পাশেই রয়েছে দুর্বল ব্যবস্থাপনার নর্দমা, যা ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
আব্বাস আলী নামের এক রোহিঙ্গা যুবক জানায়, তাদের সাত সদস্যের পরিবারের জন্য একটিমাত্র শোবার ঘর রয়েছে। কেউ কোনো রোগে আক্রান্ত হলে স্বাভাবিকভাবে অন্যদের পৃথক থাকার কোনো উপায় নেই। বিশেষ করে সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত মে মাসে এডিস মশার এক জরিপ করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবীরুল বাশার।
তখনই গবেষক দলটি ক্যাম্পে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা করেছিল বলে জানিয়ে এ অধ্যাপক বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকেই মূলত ডেঙ্গু কক্সবাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। জরিপকালেই ধারণা করেছিলাম যে জেলাটিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে যাচ্ছে। কারণ আমরা দেখেছি ক্যাম্পের ঘরে ঘরে পানির সংকট। তাদের পানি সংরক্ষণের পদ্ধতিও ভালো নয়। সংকটের সময় তারা বিভিন্ন পাত্রে পানি জমিয়ে রাখে। আর এসব পাত্রেই প্রচুর পরিমাণ এডিস মশার লার্ভা পেয়েছিলাম। এখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই সবচেয়ে বেশি।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। পরবর্তী সময়ে সেগুলো বর্জ্য হলেও তা যথাযথভাবে অপসারণ করা হয় না বলে জানান উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের মধ্যে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। এসব পরবর্তী সময়ে নর্দমায় গিয়ে পড়ে। একই সঙ্গে এসব প্লাস্টিক ও পলিথিনে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অন্যান্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও ভালো নয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছাড়াও কক্সবাজার পর্যটন এলাকা হওয়ায় সেসব এলাকায় প্লাস্টিকের ব্যবহার বেশি। একই সঙ্গে এসব বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে না বলে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গারা নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাজে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার করে। এসব প্লাস্টিক নালায় জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। ডেঙ্গু হওয়ার জন্য প্লাস্টিক অন্যতম কারণ হতে পারে। তাই পলিথিনের বিকল্প নিয়ে এখনই ভাবা উচিত।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. আশিকুর রহমান জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা অনেকটা ঘিঞ্জি এলাকায় থাকে। ঘরের পাশে বিভিন্ন খানাখন্দে তিনদিনের বেশি পানি জমে থাকলেই তাতে এডিস মশা জন্মানোর ঝুঁকি তৈরি হয়। শুরুতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যাম্পে এডিস মশা নিধনের কাজ গুরুত্বের সঙ্গে করা হয়নি। পরিবেশের ভারসাম্যও ক্যাম্পগুলোতে নেই উল্লেখ করে এ চিকিৎসক বলেন, ক্যাম্প তৈরির সময় টেকনাফ ও উখিয়ার বড় একটি অংশের গাছপালা উজাড় করা হয়েছে। এতে এলাকার বিভিন্ন পোকামাকড়ের আবাসস্থল নষ্ট হয়েছে। ফলে মশা খেয়ে ফেলার জন্য উপকারী পোকামাকড় ও ব্যাঙ ক্যাম্প এলাকায় নেই। এতে মশা নিধন হচ্ছে কম।
রাজধানী ঢাকার বাইরে দেশে একমাত্র কক্সবাজার জেলায় ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যু সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৩৭ হাজারের বেশি ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আর মারা গেছে ১৩৬ জন রোগী। রাজধানীতে আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ২৫ হাজার। আর মারা গেছে ৮০ জন ডেঙ্গু রোগী। রাজধানী ছাড়া ঢাকা বিভাগের আক্রান্ত ১ হাজার ৭০০ আর মারা গেছে দুজন। ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৫০ রোগীর বিপরীতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৭৫ রোগীর বিপরীতে মারা গেছে ৩৭ জন। খুলনায় পৌনে ২ হাজার রোগীর বিপরীতে পাঁচজন, রাজশাহীতে ১ হাজার ২০০ রোগীর বিপরীতে দুজন, বরিশালে ১ হাজার ৬০০ রোগীর বিপরীতে মারা গেছে পাঁচজন। আর রংপুর বিভাগে ৬৮ জন ও সিলেট বিভাগে ৬৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও কারো মৃত্যু হয়নি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য নিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে কাজ করছেন সাইদুজ্জামান আসিফ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেশ অভাব। একই সঙ্গে ক্যাম্পে পানির সংকটের ভয়ে কেউ কেউ পানি জমিয়ে রাখে। এতে এডিস মশা জন্মানোর ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। আবার একই ঘরে বেশিসংখ্যক মানুষ থাকায় কোনো একটি সংক্রামক রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক।
একই কথা জানিয়ে কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, পানির অব্যবস্থাপনার সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গুর সংক্রমণ জড়িত। এখানের মানুষজন বালতি, প্লাস্টিকের বড় ড্রামসহ বিভিন্ন পাত্রে পানি জমিয়ে রাখে। এতে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়। একই সঙ্গে নালা-নর্দমায়ও পানি জমে এডিস মশার জন্ম হচ্ছে। আবার ক্যাম্পের বেশির ভাগ মানুষ মশারি টানিয়ে ঘুমায় না, ফুলহাতার কাপড় পরে না। এসব কারণে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়তে পারে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য এখনই ত্রিমাত্রিক পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য এডিস মশা মারতে উদ্যোগ নিতে হবে। একটি মশাও যেন বেঁচে না থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে ও লার্ভা শেষ করতে হবে। স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা শক্তভাবে সৃষ্টি করতে হবে। আর চিকিৎসক ও নার্সদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযোগী করতে তুলতে হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-