পরিবারের ২৫ সদস্য কানাডায়

মুহিবুল্লাহ হত্যার এক বছর : ১০ অক্টোবর শুনানী শুরু, প্রধান অভিযুক্তকে বাদ দেয়ার অভিযোগ

তুষার তুহিন •

২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয় শিবিরের ডি ব্লকে ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচ) কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে সংগঠনটির চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ নিহত হন। ঘটনার এক বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল। এরই মামলার তদন্ত কাজ শেষ হয়েছে। ২৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আগামী ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হবে সাক্ষ্য গ্রহন । এছাড়া এই সময়ের মধ্যে দুদফায় মুহিবুল্লাহ’র পরিবারের ২৫ সদস্য কানাডা পাড়ি জমালেও মামলার বাদী রায় না হওয়ার আগ পর্যন্ত থাকছে রোহিঙগা ক্যাম্পেই।

মামলার বাদী, পুলিশ ও আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গুলি করে রোহিঙ্গা রেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর নিহতের ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে চলতি বছরের ১৩ জুন ৭ জনের নাম ঠিকানা ও পূর্নাঙ্গ পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি দাবী করে তাদেরকে অব্যাহতির আবেদন করে ২৯ জন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গাজী সালাহ উদ্দিন। ওই অভিযোগপত্রে ৩৮ জনকে স্বাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদন গ্রহন করে ১১ সেপ্টেম্বর ২৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

এবিষয়ে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারী কৌসুঁলী ফরিদুল আলম বলেন, ওই মামলার পরবর্তী ধার্য তারিখ ১০ অক্টোবর। সেদিন বাদীর সাক্ষ্য গ্রহন করা হবে। বাদীকে সমন জারি করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, যতদ্রুত সম্ভব এই মামলার বিচার কাজ শেষ করা হবে।

২৫ সদস্য কানাডায়, বাদী ক্যাম্পে
দ রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ নিহতের পর নিরাপত্তাহীনতায় ছিল পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। তাই বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় কানাডা সরকার মুহিবুল্লাহর পরিবারকে কানাডায় আশ্রয়ের উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে দু দফায় নিহতের স্ত্রী, সন্তান, জামাতা, মা ও দুই ভাইয়ের পরিবারের ২৫ সদস্যের শরনার্থী হিসেবে কানাডা পাড়ি জমিয়েছে। এরমধ্যে প্রথম দফায় বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) রাত ১১টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে নিহতের স্ত্রী নাসিমা খাতুন ৯ ছেলে মেয়ে এবং জামাতা (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের মুখপাত্র হাসমত উল্লাহ কানাডা যান। দ্বিতীয় দফায় কানাডার উদ্দ্যেশে ২৫ সেপ্টেম্বর ক্যাম্প ছেঢ়েছেন নিহতের মা ও দুই ভাইয়ের পরিবারের ১৪ সদস্য ।

তারা হলেন, মুহিবুল্লাহর মা উম্মে ফজল (৬০), ছোট ভাই হাবিব উল্লাহর স্ত্রী আসমা বিবি (৩৫), সন্তান কয়কবা (১৫), বয়সারা (১৩), হুনাইসা (৯), মো. আইমন (৮), ওরদা বিবি (৫) ও মো. আশরাফ (৫) । আরেক ভাই আহমদ উল্লাহর স্ত্রী শামছুন নাহার (৩৭), সন্তান হামদাল্লাহ (১১), হান্নানা বিবি (৯), আফসার উদ্দীন (৭), সোহানা বিবি (৫) ও মেজবাহ উল্লাহ (১) ।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমদ বলেন, শরনার্থী হিসেবে তারা কানডা যাচ্ছেন। তবে মামলার বাদী রায় না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবেন।

যেভাবে খুন হয় মুহিবুল্লাহ
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ সাল। এশার নামাজ শেষে মুহিবুল্লাহ নিজ শেডে প্রবেশ করেন। এরপর পরিকল্পনা মতো মুর্শিদ আমিন মুহিবুল্লাহকে বাইরে ডেকে নিয়ে প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলাপ করেন। এ সময় কিছু লোক অফিসে কথা বলবেন বলে জানালে মুহিবুল্লাহ তাঁর অফিসে যান।

মুহিবুল্লাহর অফিসে অবস্থান করার বিষয়টি মো. আনাছ ও নুর মোহাম্মদকে জানানো হয়। এ দুজনই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যদের ঘটনাস্থলে আসার সংকেত দেন। এ সময় ওঁৎপেতে থাকা সাতজন মুখোশ পরা অস্ত্রধারী মুহিবুল্লাহর অফিসে অবস্থান নেন। সেখান থেকে তিনজন মুহিবুল্লাহর অফিসে ঢোকেন। ঘটনার সময় মুহিবুল্লাহ ১০-১৫ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলছিলেন।

এ সময় অস্ত্রধারীদের একজন মুহিবুল্লাহকে বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ ওঠ’। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই প্রথম দুর্বৃত্ত একটি, দ্বিতীয় দুর্বৃত্ত দুইটি ও তৃতীয় দুর্বৃত্ত একটি গুলি করে। চারটি গুলি গায়ে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মুহিবুল্লাহ।

মূলহোতাকে বাদ দেয়ার অভিযোগ
কথিত আরসা আমির আতা উল্লাহর নির্দেশে মুহিবুল্লার হত্যা করা হয়েছে বলে আদালতে ১৬৪ ধরার জবানবন্দি দিয়েছেন আসামীরা। পাশাপশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দার সংস্থার পৃথক তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে। এরপরও এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন উখিয়া থানার ওসি তদন্ত গাজী সালা উদ্দিন আতা উল্লাহর নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি মর্মে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

অথচ সাধারণ রোহিঙ্গারা সবাই আতা উল্লাহর পিতার নাম জানেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও চট্টগ্রামে আতা উল্লাহর অস্থায়ী ঠিকানা রয়েছে। এ ছাড়াও মামালার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার আগে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি আরসা আমির আতাউল্লাহ জুনুনীর সহোদর মো. শাহ আলীকে (৫৫) আগ্নেয়াস্ত্র এবং মাদকসহ গ্রেফতার করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (১৪ এপিবিএন)। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আতাউল্লাহর সাথে তার যোগাযোগের কথা স্বীকার করেছে। তার নামে উখিয়া ও বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। শাহ আলী এখনো কারাগারে রয়েছেন।

সূত্রে মতে ও মামলার তথ্য অনুযায়ী উখিয়ার কুতুপালং ৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি-১০ ব্লক এবং চট্টগ্রাম শহরের কোতোয়ালি থানার দেওয়ান বাজারের জয়নব কলোনির তাদের আরসা নেতা আতা উল্লাহ বসতি রয়েছে। তার পিতার নাম মৃত গোলাম মোহাম্মদ। এরপরও মালার তদন্ত কর্মকর্তা আতা উল্লাহর পিতার নাম ও তার ঠিকানা পাননি বলে দাবি করেছেন।

রোহিঙ্গাদের একাধিক সূত্র দাবি করেছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গাজী সালা উদ্দিন বিপুল উৎকোচের বিনিময়ে আতা উল্লাহকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ততকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) ও বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত গাজী সালা উদ্দিন বলেন, টাকা দুরের কথা এক কাপ চা’ও আমি কারো কাছ থেকে খাইনি।

নাম ঠিকানা ও সব তথ্য থাকার পরও আতা উল্লাহকে কিভাবে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন আমি যেমন পেয়েছি তেমনি দিয়েছি।

উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, মামলাটি আমি উখিয়া থানায় যোগ দেয়ার আগে ওসির সাক্ষরে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তবে এতটুকু বলতে পারি যে- খুনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে এবং নাম ঠিকানা সব ঠিক থাকলে কোনভাবে তদন্ত কর্মকর্তা আসামীর নাম বাদ দিতে পারেন না।

বিষয়টি সম্পর্কে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন তদন্ত কর্মকর্তার সাথে টাকার লেনদেনের বিষয়টা বলতে পারবো না। তবে তদন্তে যদি আতা উল্লাহর নাম-ঠিকানা সঠিক পাওয়া যায় বা সে যদি গ্রেফতার হয় তার বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

রাষ্টপক্ষের কৌসুলী ফরিদুল আলম বলেন, আতাউল্লাহ এদেশের নাগরিক নন। তার এখানকার কোন পরিচয় নেই। এসব বিষয় চিন্তা করেই আদালত তদন্ত কর্মকর্তার অভিযোগপত্র গ্রহন করেছেন। তবে যদি আতাউল্লাহ পরিচয় জানা সম্ভব হয় সেক্ষেত্রে রায়ের আগ পর্যন্ত তাকে মামলার আসামী করার সুযোগ রয়েছে।

আরও খবর