সাহাদাত হোসেন পরশ, ঢাকা ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার •
মিয়ানমারভিত্তিক উগ্রপন্থি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) নেতা মো. সলিমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মাদক মামলার সাক্ষী হওয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এবার জোড়া খুনের ঘটনা ঘটল। টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন দুই রোহিঙ্গা নেতা (মাঝি)।
গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে উখিয়ার জামতলী এলাকার ক্যাম্প-১৫-এর সি-৯ ব্লকের দুর্গম পাহাড়ের ঢালে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন ক্যাম্প-১৫-এর ব্লক সি/১-এর আবদুর রহিমের ছেলে প্রধান মাঝি আবু তালেব (৪০) ও একই ক্যাম্পের সি/৯-এর ইমাম হোসেনের ছেলে সাব-ব্লক মাঝি সৈয়দ হোসেন (৩৫)। ক্যাম্পে যাঁরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভালো-মন্দ দেখভাল করেন, তাঁদের মাঝি হিসেবে অভিহিত করা হয়।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, চলতি বছরের ৭ এপ্রিল আরসা নেতা সলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে করা মাদক মামলার সাক্ষী ছিলেন তালেব।
ওই মামলার সাক্ষী হওয়ায় তালেব ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হোসেনের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন সলিম ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ। এ ছাড়া মঙ্গলবার রাতে তালেব ও হোসেনকে গুলি করার পর প্রথমে ক্যাম্পে একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে তাঁদের নেওয়া হয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকার সময় তাঁরা জবানবন্দি দিয়েছেন। আইনের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ডায়িং ডিক্লারেশন’।
তালেব তাঁর নূর বশার ও আরেক মাঝি সাব্বিরের কাছে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন। সেখানে উঠে আসে, ওই হত্যা মিশনে ১০-১২ জন ছিল। এতে প্রধানত সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন সলিমের ভাই মাহমুদুল ও জাহিদ। তাঁদের দু’জনের সঙ্গে আরসার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী হিসেবে মাহমুদুল ও জাহিদ অনেক দিন ধরেই তালিকাভুক্ত।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে জানায়, মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে তালেব জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছিয়া বেগমের বাড়ির সামনে বাঁশের তৈরি মাচার ওপর প্রায় প্রতিদিন রাতে গল্প করতেন দুই বন্ধু তালেব ও হোসেন।
প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবারও তাঁরা আলো-আঁধারি পরিবেশে বসে গল্প করেন। হঠাৎ একদল সশস্ত্র যুবক এসে তাঁদের এলোপাতাড়ি গুলি করে। ওই দলের অনেক সদস্য মুখোশ পরিহিত ছিল। হত্যা মিশন শেষ করেই পাহাড়ি পথ ধরে তারা পালিয়ে যায়।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই সলিমের বাহিনীর ক্যাম্প ঘিরে নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। কারাগারে যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গীরা শুরু করে গোপন তৎপরতা। সলিম ছাড়াও নবী হোসেন ও মাওলানা আজিজ নামের আরও দুই আরসার নেতার জোড়া হত্যার সঙ্গে যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
খুনোখুনি, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানব পাচারসহ ১৪ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে বসবাসরত রোহিঙ্গা অপরাধীরা। এসব অপরাধ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ বছরে শিবিরগুলোতে ৯৯টি হত্যাকা ঘটেছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ কামরান হোসেন জানান, পূর্বশত্রুতার জের ধরে ৮-১০ জন দুস্কৃতকারী রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১৫-এর সি-৯ ব্লক থেকে অনুমান ১৫০ ফুট ওপরে দুর্গম পাহাড়ের ঢালে জনৈক আসিয়া বেগমের শেডের (নম্বর ১০১০) সামনে রোহিঙ্গা মাঝি সৈয়দ হোসেন ও আবু তালেবকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
স্থানীয় রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে খবর পাওয়ার পর গুরুতর আহত অবস্থায় দু’জনকে উদ্ধার করে জামতলী এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সৈয়দ হোসেনকে চিকিৎসক সেখানেই মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত তালেবকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুতুপালং হাসপাতালে রেফার করেন চিকিৎসক। পরে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরান হোসেন আরও জানান, দুস্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করতে ক্যাম্পে ব্লকরেইড দিয়ে অভিযান চলছে। মরদেহ উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে। এ ব্যাপারে থানায় মামলা হয়েছে।
এর আগে ১ আগস্ট বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরে নুরুল আমিন (২৬) নামের এক রোহিঙ্গা যুবক খুন হয়।
জানা গেছে, ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশনের আই ব্লকে এই হত্যাকা ঘটে। মৃত নুরুল আমিন ওই ক্যাম্পের আবু শামার ছেলে।
একইভাবে ২২ জুন আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং এর আগে ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। একই মাসে ১০ জুন কুতুপালংয়ের ৪ নম্বর ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ সমিন (৩০) ও ৯ জুন রোহিঙ্গা নেতা আজিম উদ্দিনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬) নামের দুই স্বেচ্ছাসেবক। এর আগে কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে একই গ্রুপের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড শীর্ষ সন্ত্রাসী হাসিমের সহযোগী মো. শাহকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে আরসা সদস্যরাই এই হত্যাকা ঘটিয়েছে বলে জানান রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ কামরান হোসেন।
পাঁচ বছরে ৯৯টি হত্যাকা :কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা খুনোখুনি, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, অগ্নিসংযোগসহ ১৪ ধরনের অপরাধে জড়িত। এসব অপরাধের দায়ে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত থানায় ১ হাজার ৯০৮টি মামলা হয়েছে। আর এ সময়ের মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৯৯টি।
রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার অপরাধ কর্মকা বাড়ছে :গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা ও তাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে নিহতের পরিবারের সদস্যরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসাকে দায়ী করে আসছিল। এরপর ২২ অক্টোবর ১৮ নম্বর ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে গুলি করে একটি মাদ্রাসার ৬ ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-