তবিবুর রহমান •
জরুরি মুহূর্তে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন অনেক জীবন বাঁচায়। রক্তের চাহিদা চিরন্তন। তবে তদারকির অভাব ও এ খাতে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় উপকরণ সংকটে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই চলছে রক্ত পরিসঞ্চালন। এতে ঝুঁকি বেড়েছে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থাপনায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তগ্রহীতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রক্তদানের আগে অত্যাবশ্যকীয় পাঁচটি পরীক্ষার বিধান রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে মাঠ পর্যায়ে এর বাস্তবায়ন নেই। স্বল্প পরিসরে যতটুকু নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে তাকে গত তিন বছরে দেশে ১৩৯ জনের দেহে প্রাণঘাতী এইচআইভি এইডস শনাক্ত হয়েছে। ফলে পরীক্ষা ছাড়া রক্ত গ্রহণে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভিসহ প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির মাধ্যমে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ৯৯টি এবং ইউএইচসি তথা উপজেলা হেলথ কেয়ার কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারিভাবে ১২৪টি ব্লাড ব্যাংক পরিচালনা করা হয়। তবে করোনাকালে কেন্দ্রীয়ভাবে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় ব্লাড ব্যাংক ও পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে রক্তের ব্যাগ, রি-এজেন্টসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অর্থের যোগান না থাকাকে উপকরণ সংকটের মূল কারণ বলছে অধিদপ্তর।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রক্তদান ও গ্রহণে জনসচেতনতা তৈরিতে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ মঙ্গলবার, ১৪ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস-২০২২। দিবসটি পালনে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে এ বিষয়ে আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রা আয়োজনের কথা রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর দিবসটির স্লোগান নির্ধারণ করেছে- ‘ডোনেটিং ব্লাড ইজ অ্যান অ্যাক্ট অফ সলিডারিটি, জয়েন দ্য ইফোর্ট অ্যান্ড সেভ লাইভ’ অর্থাৎ ‘সংহতির উদ্দেশ্যে রক্ত দিন, এই উদ্যোগে জড়িত হোন এবং জীবন বাঁচান’।
নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিধিমালায় বলা আছে, ‘রক্তবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত ব্লাড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে প্রতি বছর রক্তের অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রক্ত সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট, কিটস, ফিজার রক্তের ব্যাগ সরবরাহ করবে সরকার। এজন্য আলাদা বরাদ্দ থাকার কথা। তবে গত বছর এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়নি। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হলেও সঠিক পরিমাণ জানাতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থেলাসেমিয়া ম্যানেজমেন্ট শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আতাউল করিম বলেন, ‘এ বছর যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা মন্ত্রণালয় থেকে এখনও ছাড় করা হয়নি। তবে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে হাসপাতালে এসব উপকরণ সরবরাহ করতে আগামী মাস পর্যন্ত লাগবে। এই সময়ের মধ্যেই উপকরণ সারাদেশে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় বছরে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ রক্ত দরকার হয়। সারাদেশে সরকারিভাবে ২২৩টি ব্লাড ব্যাংক বা রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির মাধ্যমে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ৯৯টি এবং ইউএইচসি তথা উপজেলা হেলথ কেয়ারের কর্মসূচির মাধ্যমে ১২৪টি সরকারি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে।
এর মধ্যে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও বিশেষায়িত ব্লাড ব্যাংকে রক্তদাতাদের স্ক্রিনিং করে ২০১৯ সালে ৬৪, ২০২০ সালে ৪৭ ও ২০২১ সালে ২৮ জনের এইডস শনাক্ত হয়। একই সময়ে ১৬ হাজার ৯১০ জন স্বেচ্ছা রক্তদাতার শরীরে হেপাটাইটিস-বি ও ৮৪৭ জনের হেপাইটিস-সি ভাইরাস শনাক্ত হয়। এছাড়া ২০১৯ ও ২০২০ সালে ২ হাজার ২১২ জনের যৌনবাহিত সিফিলিস রোগ ধরা পড়ে।
নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিতে যথাযথ বরাদ্দ এবং ব্লাড ব্যাংকগুলোতে তদারকি জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশব্যাপী ব্লাড ব্যাগ, কিটস ও রি-এজেন্ট সংকটের কারণে রক্তের গ্রাহকরা নিজের অর্থায়নে ব্যাগ ও কিট কিনে নিচ্ছেন। রক্তদানের আগে যে ৫ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা সেটাও অধিকাংশ সেন্টারে করা হচ্ছে না। ফলে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
‘এই সংকট নিরসনে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাড ব্যাংক বিভিন্ন সময় বিদেশে সংস্থার মান বাচাই করা হয়। বিভিন্ন দেশে নমুনা পাঠিয়েও মান যাচাই করা হয়। তবে অন্যান্য ব্লাড ব্যাংকে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থেলাসেমিয়া ম্যানেজমেন্ট শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আতাউল করিম বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারি কেনাকাটা এক বছর বন্ধ থাকায় ওই সময়কালে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন খাতে বরাদ্দ আসেনি। এ কারণে কিছু কিছু জায়গায় ব্লাড ব্যাংক ও পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে রক্তের ব্যাগ, রি-এজেন্ট ও কিটসসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সংকটে ব্যাহত হতে পারে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন।’
তবে এ বছর এই খাতে কত টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা জানাতে পারেননি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-