মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে ভারতের রোহিঙ্গারা

নিজস্ব প্রতিবেদক •

ভারতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের আটক করে সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাচ্ছে দেশটির প্রশাসন। সেখানে যাওয়ার পর সেসব রোহিঙ্গারা পুণরায় পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে।

গেল দুই মাসে দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পে এসেছে। যাদের বেশীরভাগ ভারত ফেরত।

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জম্মু শহরে বসবাসরত জাতিসংঘের নিবন্ধনধারী শরণার্থী সহ ১৭০ রোহিঙ্গাকে গত বছরের ৮ মার্চ আটক করে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যাদের রাখা হয় জম্মুর নিকটবর্তী হিরানগর জেলে।

আটকের এক সপ্তাহ পর সেসব রোহিঙ্গাকে মনিপুর প্রদেশের তেংনৌপাল জেলার সীমান্ত শহর মোরেহ’তে অবস্থিত সীমান্ত ট্রানজিট দিয়ে মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলের তমুতে দায়িত্বরত মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)’র হাতে তুলে দেয় ভারতীয় পুলিশ।

মিয়ানমার ফেরত গেলেও সেখানে কিছুদিন বসবাসের পর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে তারা, আশ্রয় নিচ্ছে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে।

যাদের একজন আলী হোসন (৩৫)। যিনি দশ বছর জম্মুতে বসবাসের পর ফেরত গিয়েছিলেন মিয়ানমারে, সম্প্রতি তিনি সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে চলে এসেছেন উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্বজনদের কাছে।

গত বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকেলে মুঠোফোনে আলীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের । আলী জানান, “জম্মুতে আমাদের উপর অত্যাচার শুরু হয়েছে। আমরা কোথায় যাবো? দেশে গিয়েও শান্তি নেই, বাংলাদেশ আমাদের জন্য নিরাপদ। তাই এখানে চলে এসেছি।”

হাসিনা বেগম (৩৭) নামে এক রোহিঙ্গা নারী জম্মুতে একা আটক হয়ে ফেরত যান রাখাইন প্রদেশে। তাঁর স্বামী সন্তানরা জম্মু থেকে পালিয়ে সিলেট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে চলে আসেন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।

পরিবার থেকে এক বছর বিচ্ছিন্ন থাকার পর হাসিনাও চার লক্ষ কিয়াট সংগ্রহ করে সম্প্রতি আলীর মতোই বাংলাদেশে এসেছেন।

দীর্ঘদিন নিজের তিন সন্তান থেকে আলাদা হওয়ার পর তাদের কাছে পাওয়া হাসিনা বলেন, “পরিবারের সাথে পুণরায় মিলিত হতে পারায় আমি খুশি। এখন এখানেই থাকব তাদের নিয়ে।”
অন্যদিকে, জম্মুতে আটক-নিপীড়ন শুরু হওয়ার পর সেখানে বসবাসরত ৫ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা শহরটি ছেড়ে পালাচ্ছেন, যাদের অনেকেই দালাল ধরে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশে।

গত শনিবার (২৮ মে) সন্ধ্যায় উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্নীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া ভারত থেকে পলাতক দুই রোহিঙ্গা পরিবারের সাত সদস্য কে আটক করে ১৪ এপিবিএন।

ইনচার্জ (সিআইসি) কার্যালয়ের মাধ্যমে কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠানো হয় বলে জানান ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক নাঈমুল হক।

তিনি বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ভারত থেকে সীমান্ত হয়ে ক্যাম্পে পালিয়ে আসার কথা স্বীকার করেছে আটক দুই পরিবার, যাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ভারত থেকে সীমান্ত হয়ে ক্যাম্পে পালিয়ে আসার কথা স্বীকার করেছে আটক দুই পরিবার, যাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হয়েছে।”
ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের একজন মোহাম্মদ তাহির জানান, “জম্মুতে থাকা রোহিঙ্গারা অশান্তিতে আছে। জাতিসংঘের শরণার্থী কার্ড থাকার পর ও সেখানকার পুলিশ রোহিঙ্গাদের ধরে মায়ানমারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমরা তাদের ভয়ে কুতুপালং পালিয়ে আসছি, আমার মতো অনেকেই চলে এসেছে এখানে।”

ভারত থেকে সম্প্রতি বেশকিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত ২৭ মে কক্সবাজারে আয়োজিত বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত নির্বাহী কমিটির ১৭তম সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের সে দেশে ফেরত পাঠানো হবে।

একই সঙ্গে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গারা যাতে বাহিরে আসতে না পারে সেদিকেও নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”

ভারত থেকে রোহিঙ্গা আসার কথা স্বীকার করে অতিরিক্ত ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসৌদ্দজা নয়ন বলেন, যারা ভারত থেকে আসছে তাদের আটকের পর আমরা ট্রানজিট ক্যাম্পে রেখেছি। তাদের বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
গেল দুই মাসে কত সংখ্যাক রোহিঙ্গা ভারত থেকে এসেছে জানতে চাইলে তিনি সংখ্যাটা জানাতে রাজি হননি।

তবে, ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত তিনটি এপিবিএনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত দুই মাসে কমপক্ষে দেড় হাজার রোহিঙ্গাকে ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে যারা ভারত থেকে পালিয়ে এসেছেন।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্যানুযায়ী ভারতের জম্মু-কাশ্মীর, দিল্লি সহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়ে শরণার্থী মর্যাদা পাওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৮ হাজার। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মতে নিবন্ধিত ছাড়াও কমপক্ষে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে দেশটিতে।

আরও খবর