শাহাদাত হোসেন পরাশ, সমকাল :
সম্পর্কে তাঁরা আপন চার বোন। দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা কারবারের পারিবারিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। টেকনাফ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৬-৭টি চালান ঢাকায় আনেন।
একেকটি চালানে দেড় হাজার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত বড়ি থাকে। ইয়াবা চক্রের পাইকারি বিক্রেতা হিসেবে এখন চার বোনই মাদক মামলার আসামি। নিজেদের শিশুসন্তানদের ব্যবহার করে ৪ বোনের মাদক কারবারের ঘটনা নজিরবিহীন।
এই চার বোন হলেন- শাহিদা বেগম (২৫), সাবিকুন্নাহার সাবু (২২), শারমিন আক্তার (২৮) ও তৈয়বা বেগম (৩৩)।
গত সোমবার রাতে ডেমরা থেকে গ্রেপ্তার হন শারমিন ও তার স্বামী রুবেল। তাদের কাছে ১০ হাজার পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের ২৮ মার্চ ডেমরার ডগাইর এলাকা থেকে প্রথমে গ্রেপ্তার হন শাহিদা ও সাবিকুন্নাহার। ওই সময় সাবিকুন্নাহারের এক ছেলে বন্ধুকে ইয়াবাসহ আটক করা হয়। তবে গ্রেপ্তারের পর শাহিদা তার নিজের পরিচয় আড়াল করেন। নিজেকে শারমিন আক্তার বলে পরিচয় দেন। এরপর তদন্তে বেরিয়ে আসে শাহিদার আরেক বোনের নাম শারমিন।
তবে শারমিন পরিচয়ে খুলনায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন শাহিদা। এরপর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত ২৩ এপ্রিল পৃথক আরেকটি অভিযান চালিয়ে ডেমরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তৈয়বা ও তার ভাই আব্দুল্লাহর স্ত্রী ইয়াসমিনকে। ওই অপারেশনে রিপা মনি নামে ১১ বছরের এক শিশুকে পাওয়া যায়। তখন জানা যায় রিপা হলো তৈয়বার সন্তান। তবে তাঁদের কাছ থেকে কোনো ইয়াবা বড়ি জব্দ না হওয়ায় সন্দেহ হয় ডিবির। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিপা ও ইয়াসমিনের পেটের এক্সরে করানো হয়। এতে চিকিৎসকরা দেখতে পান, তাঁদের পাকস্থলিতে ছোট ছোট পুঁটলির মতো কিছু রয়েছে। এরপর তাদের পাকস্থলির ভেতর থেকে দেড় হাজার পিস ইয়াবা বের করে আনেন চিকিৎসকরা।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেরিয়ে আসে, টেকনাফ থেকে রওনা হওয়ার আগে ইয়াসমিন ও রিপার পেটে কৌশলে ইয়াবা ঢোকানো হয়। মুখ দিয়ে গিলে গিলে স্কচটেপে মোড়ানো ইয়াবার পুঁটলি তারা পেটে রাখে।
সর্বশেষ সোমবার ডেমরার পৃথক আরেকটি বাসায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় শারমিন ও তার বর্তমান স্বামী রুবেলকে।
জানা গেছে, শারমিন প্রথমে রায়হান নামে এক যুবককে বিয়ে করেন। এরপর টেকনাফের ইয়াবা কারবারি রুবেলকে বিয়ে করেন তিনি। কিছুদিন আগে একটি মামলায় রুবেল কারাভোগ করে জেল থেকে বের হন। মূলত ইয়াবা কারবার করাতে শারমিনকে বিয়ে করেন রুবেল। এরপর স্বামী-স্ত্রী মিলে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
ডিবির আরেক কর্মকর্তা বলেন, সাবেকুন্নাহার বাদে তাঁর তিন বোনই দুটি করে বিয়ে করেছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা এ ধরনের কারবারে জড়িত। তাঁদের একমাত্র ভাই আব্দুল্লাহও ইয়াবা কারবারি। গ্রেপ্তারের পর চার বোন তাঁদের ছদ্ম নাম ব্যবহার করেন। এরপর ডিবির পক্ষ থেকে তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা ও মা-বাবার পরিচয় জানতে শুরু হয় অনুসন্ধান।
টেকনাফের স্থানীয় পুলিশ ও ৫ নম্বর বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল লিখিতভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান, চার বোনের বাবার নাম আলী আহমদ কাশেম মো. ফজলুল হক। তাঁদের মা মৃত হাছিনা বেগম। তাঁরা টেকনাফের নয়াপাড়ায় ৫/৬ বছর ধরে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করে আসছেন। তাদের স্থায়ী ঠিকানার ব্যাপারে কোনো তথ্য ইউনিয়ন পরিষদে নেই।
তবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চার বোন জানিয়েছেন, তাঁদের বাবা ফজলুল হক ইয়াবা কারবারে সম্পৃক্ত। তাঁদের মায়ের বিয়ের পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন বাবা। তবে তাঁরা বাবার প্রথম ঘরের সন্তান। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বাবার আসল পরিচয়ও তাঁরা গোপন করেন। কখনও বলেন শামসুল হক। কখনও জানান আহমেদ।
পরে জানা যায়, শামসুল হক হলেন শাহিদার শ্বশুরের নাম। আর আহমদ হলেন তাঁদের ভাই আব্দুল্লাহর শ্বশুর। মূলত মামলা থেকে সুবিধা নিতে বারবার তাঁরা নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের নাম-পরিচয় লুকানোর চেষ্টা করেছিলেন।
ডিবির উত্তরা বিভাগের ডিসি কাজী শফিকুল আলম বলেন, এই চক্রটি মূলত ঢাকার উপকণ্ঠে ইয়াবা কারবার করে আসছিল।
টেকনাফ থেকে চালান এনে ডেমরায় তাঁদের আস্তানায় রাখতেন। এরপর সুবিধামতো সময়ে তা পাইকারি কারবারিদের কাছে হস্তান্তর করেন। চার বোনের নেটওয়ার্ক থেকে যারা নিয়মিত ইয়াবা কিনে আসছিল তাদের কিছু নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। অল্প সময়ের মধ্যে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-