বিশেষ প্রতিবেদক •
কক্সবাজার জেলা কারাগারের বিতর্কিত জেল সুপার নেছার আলমকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ৩০ মে তাকে সশরীরে দুদকের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সিনিয়র কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দেশের কেন্দ্রীয় কারাগারসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কারাগারে দীর্ঘ ২৩ বছর চাকরিকালে অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি।
অল্প বয়সে পিতৃহারা নেছার আলম তার এলাকার প্রয়াত একজন রাজনৈতিক নেতার আনুকূল্যে সরকারি চাকরির বয়স সীমার প্রান্তিক লগ্নে বৃহত্তর সিলেট বিভাগের সন্তান তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন্স (কারা অধিদপ্তর) আবদুর জাহের এবং তৎকালীন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শকের একান্ত আনুকূল্যে ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পরও বিশেষ কৌশলে উত্তরপত্রের ফলাফল পরিবর্তন করে চাকরি পান। অত্যন্ত হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান নেছার আলমের মা ছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের একজন সাধারণ কর্মী, হাসপাতালের আয়া। কিন্তু তার ভাগ্য বদল হতে শুরু করে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর।
নাটকীয় উত্থান হয় তৎকালীন কারা মহাপরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন কারা মহাপরিদর্শক হিসাবে কারা বিভাগে যোগ দিলে। বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্মরত থাকাকালে বিভিন্ন পদে কারা বিভাগে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং কারাগারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের বদলি, পদায়ন, পদোন্নতির জন্য নেছার আলম ছিলেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। এসব নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি বাণিজ্যের পাশাপাশি তিনি কারাগারের জেলার হিসাবে বন্দিদের খাদ্য সরবরাহে অনিয়ম, বন্দিদের সিট বিক্রি, হাসপাতালে সুস্থ লোককে অসুস্থতার অজুহাতে ভর্তি বাণিজ্য, জামিন বাণিজ্য, কারা ক্যান্টিনে উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি করে আদায় করা বিপুল লভ্যাংশ পকেটস্থ করে কামিয়েছেন শত কোটি টাকা।
অভিযোগ আছে, নেছার আলম কক্সবাজার জেলা কারাগার যোগদানের পর থেকে কক্সবাজার জেলা কারাগারকে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন। কক্সবাজারের স্থানীয় এক শ্রেণির অসাধু কারা ঠিকাদারসহ দুর্নীতিবাজ এক শ্রেণির কারা কর্মচারীদের নিয়ে জোট বেঁধে চালিয়ে যাচ্ছেন অনিয়ম-দুর্নীতির রাম রাজত্ব। বন্দিদের খাদ্য সরবরাহে অনিয়ম, কারাগারের ক্যান্টিনের উচ্চ মূল্যের পণ্য বিক্রয়, কারা হাসপাতালে রোগের অজুহাতে সুস্থ-মাদক ব্যবসায়ীদের থাকার সুযোগ, কারাগারের বন্দিদের জন্য অনুমোদিত সরকারি মোবাইল অনিয়ম ও চরম ব্যাণিজ্যিক ব্যবহারের লক্ষ্যে নেছার আলম গড়ে তুলেছেন বিশাল সিন্ডিকেট। নেছার আলম এমনই বেপরোয়া যে তার নানা অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন সময় যুগান্তরসহ স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় সচিত্র সংবাদ ছাপা হলে নিজের অপকর্ম ঢাকতে কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কতিপয় কারা কর্মচারীদের দেশের বিভিন্ন কারাগারে হয়রানিমূলক বদলি করেন। তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি সংশ্লিষ্টরা। এতে করে নেছার আলম আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। কক্সবাজার কারাগারের অতীতের সব অনিয়ম-দুর্নীতির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন সদ্য কারামুক্ত কয়েকজন বন্দি।
সদ্য কারামুক্ত কক্সবাজারের কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, কক্সবাজার কারাগার নিয়ে সম্প্রতি অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ পরিবেশনের পর কিছুদিন চোখে পড়ার মতো যেসব অনিয়ম ছিল তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নেছার আলমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। কারাগারে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ী থেকে শুরু সাধারণ বন্দিদের কাছ থেকে নানা পন্থায় মোটা অঙ্কের মাসিক চাঁদা আদায় করে চলেছেন।
এ ছাড়াও বন্দি বেচাকেনা, সাক্ষাৎ বাণিজ্য ও সরকারি মোবাইল নিয়ে বাণিজ্যসহ সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে বলে বিশ্বস্ত কারা সূত্রে জানা গেছে। এমন কি কারাগারে থাকা কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ীর কাছে লাখ টাকার বিনিময়ে অবৈধ মোবাইল দিয়ে সার্বক্ষণিক মোবাইল সুবিধা দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এতে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কারাগারে বসে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
এছাড়াও ঢাকার বনানীতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নিজ জেলা সুনামগঞ্জ প্রচুর জমি-জমা, বিলাসবহুল বাড়ি সিলেট শহর ও দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রেও বাড়িসহ অঢেল অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও কারা অধিদপ্তর থেকে সুষ্ঠু তদন্ত করা হলে এসব অবৈধ সম্পদের সঠিক তথ্য বের হয়ে আসবে বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠজনরা।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা কারাগারের আলোচিত তিন চরিত্র জেল সুপার নেছার আলম, দুর্নীতিবাজ হিসাবরক্ষক ইফতেখার আলম এবং কারা ঠিকাদার মুজিবুল হক মানিকের ম্যানেজার নুরুল আলম প্রকাশ ভাগিনা আলম। এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন আরও কয়েকজন কারা কর্মচারী। কক্সবাজার বার্মিজ স্কুল এলাকার সাবেক কারা ঠিকাদার মরহুম মকবুল হোসেনের পুত্র মুজিবুর রহমান মানিকের ম্যানেজার খ্যাত বহু অপকর্মের হোতা ভাগিনা আলম কারা ঠিকাদার না হয়েও তার হাতেই যেন ঘুরছে কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দিদের খাদ্য সরবরাহসহ কারা প্রশাসনে যুক্ত কারা কর্মচারীদের ভাগ্যচক্র।
কারা অধিদপ্তরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, নেছার আলম কোটি টাকার বিনিময়ে কক্সবাজারে পোস্টিং নিয়েছেন। তিনি যতই দুর্নীতি বা অপরাধ করেন না কেন তা ধামাচাপা দেওয়া এবং তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার মতো কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় এবং কারা অধিদপ্তরে কর্মরত রয়েছেন। যাদের তিনি নিয়মিত মাসোহারাও দেন।
এদিকে ৮ মে জেলা জেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে কক্সবাজার কারাগারে ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে জেল সুপারের কাছে জানতে চান জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ। তিনি এ সময় এসবের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। জেল সুপার নেছার আলম তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময় সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে বলে দাবি করেন। আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে উপস্থিত সংশ্লিষ্টদের কয়েকজন এ তথ্য জানিয়েছেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়-জেল সুপার নেছার আলম ৩০ মে দুদকের নোটিশ মোতাবেক হাজির হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি অসুস্থতার অজুহাতে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ কিংবা গ্রেফতার এড়াতে তার দুজন বিশ্বস্ত কর্মকর্তার পরামর্শে মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়ে অনুপস্থিত থাকতে পারেন। তবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ রয়েছেন এবং ২৭ মে নৈমিত্তিক ছুটিতে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলেন এবং বিমানে সিলেট-ঢাকা হয়ে সরাসরি কক্সবাজার ফিরে আসেন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত নেছার আলম বলেন, কক্সবাজার কারাগারে ক্যান্টিন ও মোবাইল ফোন ব্যবহারে কোনো অনিয়ম নেই। দুদকের চলতি মাসের ৩০ তারিখে কি বিষয়ে ডাকা হয়েছে জানতে চাইলে বিষয়টি প্রতিবেদক কিভাবে জানেন ব্যাখ্যা চান। তিনি ক্ষিপ্তভাবে ফোনের সংযোগ বিছিন্ন করে দেন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-