রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে মানবপাচার

কেউ অর্থের লোভে, কেউ সংসার পাততে অথৈ সাগর পাড়ি দিচ্ছে

নাজিম মুহাম্মদ :

ফাইল ছবি

মিয়ানমারের নাগরিক ওমর আকবর। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। নিয়ম অনুযায়ী ওমরের ক্যাম্পের বাইরে যাবার কথা নয়। বাস্তবতা হলো ওমর (৫১) ক্যাম্পে বসবাস করেন না। থাকেন টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের কচ্ছপিয়া গ্রামের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে।

ওমরের ছেলে রশিদ মিয়া (২৮) থাকেন বাবার সাথে। পিতা পুত্র দু’জনই মানবপাচারে অভিযুক্ত। ওমর কিংবা রশিদ নয়। মিয়ানমারের বাসিন্দা ইউনুছ (২৯), বাদশা মিয়া (২৯) বশর কিংবা বালুখালি ক্যাম্পের সৈয়দ হোসেনের মতো অনেক রোহিঙ্গা মানব পাচারে জড়িত। এরা প্রত্যেকে মানব পাচার মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তারা ক্যাম্প কেন্দ্রীক মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের সাথে জড়িত।

ক্যাম্প ঘিরে বাঙালি আর রোহিঙ্গা মিলে গড়ে তুলেছে মানব পাচার সিন্ডিকেট। কেউ অর্থের লোভে আবার কেউ স্বপ্নের মানুষের সাথে সংসার পাততে মালেশিয়ায় যেতে দিচ্ছে অথৈ সাগর পাড়ি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা উত্তাল সাগর পাড়ি দিচ্ছে তাদের অধিকাংশ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। লোভে পড়ে মাঝে মাঝে ঝুঁকি নিচ্ছে বাঙাালিও।

এতে অনেকের সলিল সমাধি হচ্ছে মাঝসাগরে, আবার অনেকে হয়তো পৌঁছে যাচ্ছে স্বপ্নের মালেশিয়ায়। সর্বশেষ গত ১১ এপ্রিল মানবপাচারে অভিযুক্ত থাকার অপরাধে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এর আগে গত ৫ এপ্রিল উখিয়া উপজেলা সদর এলাকা থেকে নারী ও শিশুসহ ৪৮ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।

উখিয়া থানার ওসি আহমেদ সঞ্জুর মোরশেদ জানান, পাচারের উদ্দেশে টেকনাফ থেকে কক্সবাজারের দিকে রোহিঙ্গাদের বহনকারি একটি বাস আসার খবর পেয়ে উখিয়া সদরে একটি তল্লাশি চৌকি বসানো হয়। বাসটি পৌঁছালে ১৭ নারী, ২২জন পুরুষ, ছয়জন মেয়ে শিশু ও তিনজন ছেলে শিশুকে উদ্ধার করা হয়।

গত ২৫ মার্চ ভোররাতে শামলাপুর উপকূলের গভীর সাগরে অভিযান্ চালিয়ে ৩৫ নারী-শিশুসহ ৫৮ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে র‌্যাব। মানবপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে এ সময় দুইজনকে আটক করে। জব্দ করা হয় একটি ট্রলার।

র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খাইরুল ইসলাম সরকার জানান, ট্রলারের ডেকের নিচে ‘বিশেষ কায়দায় জিম্মি’ করে রাখা অবস্থায় রোহিঙ্গা নারী পুরুষদের উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে একজন স্থানীয় ব্যক্তিও রয়েছে। আটক করা হয় দুই পাচারকারীকে। উদ্ধার রোহিঙ্গারা র‌্যাবকে জানিয়েছে, মালেশিয়ায় উচ্চ বেতনে বিভিন্ন পেশায় চাকরি করতে যাচ্ছিলো তারা।

স্থানীয় দালালের মাধ্যমে জনপ্রতি ৫৫ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রাথমিকভাবে ১০হাজার টাকা করে দালালকে দেয়। বাকি টাকা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থানকারি পচারকারি চক্রের জাহাজে উঠার পর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আদায়ের কথা ছিল।

এ ব্যাপারে র‌্যাব-১৫ এর এসআই আবু ছায়েদ বাদী হয়ে উখিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় গ্রেপ্তার সোহেল ও মুছা কলিমুল্লাহ ছাড়া আরো চারজনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন, বোটের মালিক বাহাদুর, পুতিয়া, জাকির, ও নুরে আলম।

গত ২১ মার্চ সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে ১৩৫ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে পুলিশ। এদের মধ্যে ৫৭ জন নারী, বাকিরা পুরুষ ও শিশু। তাদেরকে মালেশিয়া নেয়ার কথা বলে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে নামিয়ে দেয়া হয়।

২০১০ সালের দিকে সর্বপ্রথম কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকা দিয়ে সাগর পথে মালেশিয়ায় মানবপাচার শুরু হয়। ২০১২ সালের পর থেকে মানব পাচারের প্রবণতা বেড়ে যায়।

পরে টেকনাফ ছাড়াও জেলার মহেষখালী, কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, রামু ও পেকুয়ার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে সাগর পথে মানবপাচারের ঘটনা বেড়ে যায়।

মানব পাচার রোধে ২০১৪ সালে ৮টি সুপারিশের কথা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিলো পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি। কমিটি ১১ জন আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী, ২৩০ জন বাংলাদেশি পাচারকারী ও সাতজন হুন্ডি ব্যবসায়ী চিহ্নিত করেছিলো।

চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান), বর্তমানে পিবিআই’র (পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন) ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের নেতৃত্বে উক্ত তদন্ত কমিটির তিন সদস্য ছিলেন, চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার (সদর) নিয়াজ মোহাম্মদ, নগর বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাইমুল হাছান ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহম্মেদ। ৮ বছর পার হলেও কমিটির দেয়া ৮ সুপারিশ আালোর মুখ দেখেনি।

আরও খবর