আবদুল আজিজ, বাংলা ট্রিবিউন :
কক্সবাজারে শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম চলছে। জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে গড়ে ওঠা ৩৫টি মহালে শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে। এ বছর ৪০ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। আবহাওয়া ভালো থাকায় চলতি মৌসুমে ক্ষতি পুষিয়ে লাভের আশা করছেন তারা।
যেভাবে শুঁটকি উৎপাদিত হয় এবং পেশাজীবীর সংখ্যা
কক্সবাজার শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নাজিরারটেক। এখানে গড়ে উঠেছে দেশের বৃহৎ শুঁটকিপল্লি। এই পল্লির যেদিকে চোখ যায়, হরেক রকমের মাছ দেখা যায়। ভাদ্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। সাগর থেকে আহরণ করা ২০ ধরনের মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করেন তারা। শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন লক্ষাধিক মানুষ।
শুঁটকিপল্লি ঘুরে দেখা যায়, সাগর থেকে আহরণ করা লইট্যা, ছুরি, লাক্ষ্যা, চামিলা ও ফাইস্যাসহ হরেক রকমের মাছ বাঁশের তৈরি মাচায় ঝুলানো কিংবা বিছিয়ে দিতে ব্যস্ত সময় পারছেন কয়েক হাজার শ্রমিক। তপ্ত রোদে ঘাম ঝরানোর এই কাজে নারীর সংখ্যাই বেশি। অনেকের এই পেশা একমাত্র অবলম্বন। তবে মালিকপক্ষের মজুরির টাকায় সংসার চলে না তাদের।
শ্রমিকদের ভাষ্য
শুঁটকিপল্লির শ্রমিক ছকিনা বেগম বলেন, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সওদাগরদের (মালিক) নির্দেশনা মেনে কাজ করি। দৈনিক ৩৫০ টাকা বেতন দেয়। আয়ের চেয়ে খরচ বেশি। এই টাকায় সংসার চলে না। তবু পেটের দায়ে কাজ করি।’
মরজিনা আক্তার নামে আরেক শ্রমিক বলেন, ‘সাগর থেকে আহরণকৃত মাছ বেছে পৃথক করি। তারপর রোদে শুকাই। এভাবেই দিন যাচ্ছে। আমার তিন সন্তান রয়েছে। দুজন স্কুলে পড়ে, খরচ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে আছি। এজন্য কয়েক বছর ধরে এই কাজ করছি।’
শ্রমিক মোহাম্মদ আরাফাত বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত কাজ করি। ৩০০ টাকা মজুরি দেয়। যারা কাজ বেশি জানে তারা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত পায়। অধিকাংশ শ্রমিক ৩০০ টাকাই পায়।’
নুরুল কাদের বলেন, ‘শহরের বাইরে থেকে এসে কাজ করছি। ভাড়া বাসা নিয়ে থাকি। ৪০০ টাকায় খরচ পোষায় না। তবু কাজ না পেয়ে এখানে পড়ে আছি।’
যা বলছেন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা
ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদ বাদশা বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টির কারণে মাছ নষ্ট হওয়ায় লোকসানে পড়েছি। আশা করছি, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবো। সড়ক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। যেখানে-সেখানে কম সময়ে শুঁটকি পাঠানো যায়।’
ব্যবসায়ী নাজেম উদ্দীন বলেন, ‘১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক এখানে কাজ করেন। চলতি মৌসুমে সাগরে মাছ কম, তাই দামও বেশি। বাজার মূল্য পেলে আশা করছি লাভ হবে। এ পর্যন্ত এক কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে।’
নাজিরারটেক মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ বলেন, ‘২০১৯-২০ সালে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ৭০ লাখ টাকার অর্গানিক শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে। চলতি মৌসুমে এক কোটি টাকার শুঁটকি বিক্রির আশা করছি। সেভাবে কাজ চলছে।’
যে পরিমাণ শুঁটকি রফতানি হয়
দেশে মোট চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ শুঁটকি কক্সবাজারে উৎপাদিত হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর বিদেশে ৪০০ কোটি টাকার শুঁটকি রফতানি হচ্ছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোনও বছর শুঁটকি উৎপাদন ব্যাহত হলে রফতানির পরিমাণ কমে যায়।
দেশে শুঁটকির বিপ্লব ঘটানোর প্রত্যাশা
কক্সবাজারে উৎপাদিত শুঁটকির মানোন্নয়নে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সহায়তা করছে। ভবিষ্যতে অর্গানিক শুঁটকির বিপ্লব ঘটবে বলে প্রত্যাশা করছেন ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীরা।
মৎস্য বিভাগের মতামত
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জামান বলেন, ‘কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকসহ নয় উপজেলার ৩৫ মহালে চলতি মৌসুমে শুঁটকি উৎপাদনের টার্গেট ধরা হয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিক টন। যা গত বছর ছিল ২৫ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন। প্রতিবছর দেশের চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৪০০ কোটি টাকার শুঁটকি রফতানি হয়। শুঁটকির মানোন্নয়নে বিভিন্ন সংস্থা সহায়তা করছে। ভবিষ্যতে অর্গানিক শুঁটকির বিপ্লব ঘটবে বলে আশা করা যায়।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-