সিনহা হত্যা মামলা : সাতদিনের মধ্যে আপিল করতে পারবে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তরা

বিশেষ প্রতিবেদক •

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান আলোচিত হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ (৪৮) ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে (৩১) মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়েছে।

এখন এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।

পুলিশের সাবেক পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর আইনজীবী চন্দন দাস বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব। একই বক্তব্য অন্য আসামির আইনজীবীদেরও।

এখন নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের রায় (ডেথ রেফারেন্স) হাইকোর্টে আসার কথা রয়েছে। এরপর আসামিদের মধ্যে যারা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে ইচ্ছুক তদের আপিল দায়েরের পর পেপারবুক তৈরি করে শুনানির প্রস্তুতি নেবেন আইনজীবীরা।রায়ের শেষাংশে বলা হয়েছে, রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা চাইলে বা ইচ্ছা করলে সাত কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল আবেদন করতে পারবেন।

দেশব্যাপী আলোচিত এ হত্যা মামলার রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ হাইকোর্টে আপিল করবেন আইনের বিধান অনুযায়ী। বিচারিক আদালতের রায়ের কপি হাইকোর্টে আসতে ফৌজদারি কার্যবিধির কয়েকটি ধারা অনুসরণ করা হবে।

ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এজন্য ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের) নথিপত্র হাইকোর্টে আসবে রায় ঘোষণার সাতদিনের মধ্যে। তামাদি আইনের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে সাতদিনের মধ্যে। এরপর যথযাথ নিয়ম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য তৈরি করা হবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত)।

সাধারণত ডেথ রেফারেন্স শুনানি করা হয় বিভিন্ন উচ্চ আদালতের নিয়ম অনুযায়ী। তবে প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিলে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত করা হবে দ্রুত সময়ের মধ্যে। ইতোপূর্বে বিভিন্ন মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানির ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি এ রকম নির্দেশ দিয়েছিলেন।

হাইকোর্ট ডেথ রেফারেন্স শুনানি করে মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখতে বা কমাতে পারেন। আইন অনুযায়ী আসামিরাও সাজা থেকে খালাসের জন্য আপিল করতে পারবেন। তামাদি আইনের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয়। আপিল করলেই বিচারিক আদালতের সাজা স্থগিত হয়ে যাবে। এটি আইনের বিধান। ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করবেন হাইকোর্ট। এরপর এ মামলার কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে আপিল করতে পারবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। এখানে আপিল আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। এরপরই চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হবে।

ফৌজদারি কার্যবিধির কতিপয় ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সুপ্রিম কোর্টে আপিলের বিধান করা হয়েছে। আপিল বিভাগে যাওয়ার আগে প্রয়োজন হতে পারে লিভ টু আপিলের (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন)। লিভ টু আপিল গ্রহণ করা হলে আপিল করতে পারবেন সংক্ষুব্ধ আসামি বা বাদীপক্ষ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৪২ (ক) ধারা অনুযায়ী আপিল নিষ্পত্তি করতে হবে। আপিল দায়েরের পর ৯০ দিনের মধ্যে সেটি নিষ্পত্তি করতে হয়। আপিলে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন আসামিরা। দণ্ডবিধির ৫৫ (ক) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আসামিকে ক্ষমা করে প্রাণভিক্ষাও দিতে পারেন।

প্রসঙ্গত সিনহা মো. রাশেদ খান আলোচিত হত্যা মামলায় ৩১ জানুয়ারী সোমবার দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল সিনহা হত্যা মামলার রায় পড়া শুরু করেন। আলোচিত এ হত্যা মামলায় প্রদীপ কুমার দাশ (৪৮) ও মো. লিয়াকত আলীকে (৩১) মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত।

এ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবনপ্রাপ্তরা হলেন, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত (৩০), ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), কনস্টেবল সাগর দেব, স্থানীয় বাসিন্দা বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)।

আর খালাসপ্রাপ্তরা হলেন, পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান আলী (৪৭), কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩) ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০)।

এক নজরে ঘটনাক্রম

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সোয়া ৯ টা

কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএনের চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান।

২০২০ সালের ১ আগস্ট

পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা করে। সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে মামলা দুটি করে পুলিশ। টেকনাফ থানায় করা দুই মামলায় সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। রামু থানায় মাদক আইনে করা মামলাটিতে আসামি করা হয় সিনহার অন্য সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে।

২০২০ সালের ৫ আগস্ট
সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন—টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, উপ-পরিদর্শক (এসআই) টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা। মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করার পর আদালত তদন্তভার দেন র‍্যাবকে। একই সঙ্গে পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটিও র‍্যাবকে তদন্ত করার আদেশ দেন আদালত।

২০২০ সালের ৬ আগস্ট
সকালে মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করে তদন্তের জন্য র‍্যাবে হস্তান্তর করা হয়। ওই দিন বিকেলে মামলায় আসামি সাতজনের মধ্যে সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা নামের কোনো পুলিশ সদস্য জেলা পুলিশে কর্মরত ছিলেন না। ওই দিনই আত্মসমর্পণকারী আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

২০২০ সালের ১১ আগস্ট
পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরে তাঁদের আদালতে সোপর্দ করা হয়। ওই দিনই তাঁদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

২০২০ সালের ১৮ আগস্ট
এপিবিএনের তিন সদস্য সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান মিয়া, কনস্টেবল মো. রাজীব ও কনস্টেবল মো. আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এরপর তাঁদের আদালতে সোপর্দ করা হয়। ওই দিনই তাঁদের রিমান্ড আবেদন করে র‍্যাব।

২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর
কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে র‍্যাব। ওই দিনই তাঁর বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

পরে কারাগারে থাকা ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর
র‍্যাব-১৫-এর কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিলেন। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে। একই দিন পুলিশের করা মামলা তিনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর
আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে পুলিশের করা তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহর আদালত থেকে মামলাটির কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালতে স্থানান্তর করা হয়।

২০২১ সালের ২৪ জুন
পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত ওই দিনই তাঁকে কারাগারে পাঠান।

২০২১ সালের ২৭ জুন
আদালত ১৫ আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেন। একই সঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত দিন ধার্য করেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় ধার্য দিনগুলোতে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি।

২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর
আট দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য দেন। প্রথম দফায় ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে দুজনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয় দফায় ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় চারজনের। তৃতীয় দফায় ২০ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে সম্পন্ন হয় আটজনের সাক্ষ্যগ্রহণ। চতুর্থ দফায় ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা করা হয় ছয়জনের। পঞ্চম দফায় ১০ থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনে ১৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়।

ষষ্ঠ দফায় ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় ২৪ জনের। সপ্তম দফায় ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ছয়জন সাক্ষ্য দেন। এদের মধ্যে পাঁচজনের জেরা সম্পন্ন হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা অসম্পন্ন ছিল। সর্বশেষ অষ্টম দফায় ২৯ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়।

২০২১ সালের ৬ ও ৭ ডিসেম্বর
আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন।

২০২২ সালের ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি
মামলায় উভয় পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন।

২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি
যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিন আদালত ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।

আরও খবর