কঠোর বিধি এ সপ্তাহেই

রাজবংশী রায় •

দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়ছে। দুই দিন ধরে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই শুরু হয়েছে বাণিজ্য মেলা।

চলছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জনবহুল কর্মকাণ্ড। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছে পুরোদমে। বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্র থেকে শুরু করে সড়ক-মহাসড়ক, গণপরিবহন, শপিংমল, দোকানপাট সর্বত্র উপচেপড়া ভিড়। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানার তৎপরতা নেই। অধিকাংশ মানুষ মাস্ক পরছে না। পাশাপাশি দেশের প্রবেশদ্বারগুলোতেও নেই কোনো কড়াকড়ি। আফ্রিকার সাতটি দেশের বাইরে ওমিক্রন সংক্রমিত কোনো দেশ থেকে যাত্রীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে রয়েছে শুধু ১৫ দফা নির্দেশনা মানার আহ্বান।

গত মঙ্গলবার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে বিধিনিষেধ আরোপ করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে চলতি সপ্তাহেই বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে বলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বিধিনিষেধে মাস্ক পরার ওপরই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। গণপরিবহন, দোকানপাট, শপিংমল, কারখানা, অফিস-আদালত, বিনোদন কেন্দ্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সবই চালু থাকবে, তবে জনসমাগম অর্ধেক বা তার কম রাখতে হবে।

কবে নাগাদ বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল সমকালকে বলেন, শিগগিরই বিধিনিষেধ আরোপ করার চিন্তাভাবনা চলছে। কারণ, বিধিনিষেধ আরোপ করে বাস্তবায়ন করা না গেলে তা কোনো কাজে আসবে না। সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। সেজন্য একটু সময় লাগছে।

মন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান সব সময় জানিয়ে আসছি। কিন্তু মানুষ মানছে না। এখন বিধিনিষেধ আরোপ করে জোর করে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে।

গত মঙ্গলবার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় করোনা নিয়ন্ত্রণে ১৫ দিনের মধ্যে ‘কঠোর’ বিধিনিষেধ আরোপের কথা জানানো হয়। কিন্তু সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে, তাতে ১৫ দিন বেশি সময় উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাত দিনের মধ্যে বিধিনিষেধ আরোপের সুপারিশ করেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। এরপর গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, আগামী দু-একদিনের মধ্যেই বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।

সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে, সভার সিদ্ধান্তগুলো বিধিনিষেধ আকারে চলতি সপ্তাহেই জারি করা হবে। এ-সংক্রান্ত সব প্রস্তুতি শেষ করে আনা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে বিধিনিষেধ জারির বিষয়ে এক ধরনের সিদ্ধান্ত আছে। সেটি সম্ভব না হলে চলতি সপ্তাহের মধ্যেই আরোপ করা হবে। কারণ, সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে, তাতে আরও সময় নিয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে সংকট বাড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, বিধিনিষেধ আরোপ করতে গেলে আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে যুক্ত করতে হবে। যেমন যিনি বা যারা সরকার আরোপিত বিধিনিষেধ মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। সেজন্য ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ লাগবে। তাদেরও এ বিষয়ে প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। এ জন্য একটু সময় লাগছে। তবে দ্রুততম সময়ে বিধিনিষেধ কার্যকর হবে।

না মানলে শাস্তি :সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে, আরোপ করতে যাওয়া বিধিনিষেধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হবে।

এ জন্য মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে। টিকা নেওয়া থাকলেও বাইরে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক ছাড়া কেউ চলাফেরা করলে তাকে দণ্ড ও জরিমানা গুনতে হবে। গণপরিবহন বাস-লঞ্চ ও ট্রেনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। মাস্ক ছাড়া কোনো যাত্রী গণপরিবহনে চলাচল করতে পারবে না।

এ জন্য মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে। টিকা নেওয়া থাকলেও বাইরে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক ছাড়া কেউ চলাফেরা করলে তাকে দণ্ড ও জরিমানা গুনতে হবে। গণপরিবহন বাস-লঞ্চ ও ট্রেনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। মাস্ক ছাড়া কোনো যাত্রী গণপরিবহনে চলাচল করতে পারবে না। এ জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

রাত ৮টার পর শপিংমল ও দোকানপাট বন্ধ রাখতে হবে। খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। তবে এসব হোটেল ও রেস্টুরেন্টের ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক মানুষ বসে ক্ষেতে পারবে। একই সঙ্গে তাদের টিকাকার্ড দেখাতে হবে।

সূত্রটি আরও জানায়, সব ধরনের জনসমাবেশ, পর্যটন স্থান, বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল, থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম লোক অংশ নিতে পারবে। মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে।

আক্রান্ত দেশ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টারে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবাগ্রহীতা, সেবাপ্রদানকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি সংশ্নিষ্টদের দাপ্তরিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

কঠোর প্রয়োগ চান বিশেষজ্ঞরা :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে, তাতে বিধিনিষেধ দ্রুততম সময়ে আরোপ করা প্রয়োজন। বিলম্ব করলে বিপদ বাড়বে। এর আগেও বিধিনিষেধ আরোপ করতে বিলম্বের কারণে সংক্রমণ সর্বত্র ছড়িয়েছিল। এবারও তেমন অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিধিনিষেধ যেন একটি আদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। মাঠে যেন এটির কঠোর প্রয়োগ হয়। অন্যথায় ফল আসবে না।

কভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, বিধিনিষেধ আদেশ জারি করে বসে থাকলে চলবে না। যেমন, বিয়ের অনুষ্ঠানে সীমিত পরিসরে করার কথা বলা হয়েছে। এখন দুই পরিবারের সদস্যসহ ৫০ জন নাকি ১০০ মানুষ থাকবে অথবা সেটি কীভাবে হবে, তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সেটি নজরদারি করতে হবে। জনসমাগম বেশি হলে বিধিনিষেধে যে দণ্ড নির্ধারণ করা থাকবে, তা আরোপ করতে হবে। একই সঙ্গে মাস্ক ব্যবহার না করলে যে শাস্তির উল্লেখ থাকবে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় এই বিধিনিষেধ আরোপ করে কোনো লাভ হবে না।

ডা. সহিদুল্লা আরও বলেন, বিধিনিষেধের কঠোর প্রয়োগের সঙ্গে দেশের প্রবেশদ্বারে স্ট্ক্রিনিং জোরালো করতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশফেরতদের সঠিকভাবে কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন মানতে হবে। সংক্রমণ বেড়ে গেলে হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়বে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সাধারণ শয্যা, আইসিইউ শয্যা ও পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

সংক্রমণ বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ :মানিকগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থায় চলতে থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই।
গতকাল দুপুরে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গড়পাড়া শুভ্র সেন্টারে মন্ত্রী নিজ অর্থায়নে দুই হাজার শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।

এ সময় তিনি বলেন, সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দোকানপাটে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে মাস্ক পরতে হবে। না পরলে জেল-জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে।

আরও খবর