শিরক শব্দের আভিধানিক অর্থ-অংশীদারিত্ব, অংশীবাদ, মিলানো, সমকক্ষ করা ভাগাভাগি কিংবা সম্পৃক্ত করা। মহান আল্লাহ তায়ালার চূড়ান্ত ঘোষণা ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরীক করবে না।’ (সূরা নিসা-৪, ৩৬)
শিরক হচ্ছে বান্দা আল্লাহ তালায়ার সাথে তার রুবুবিয়্যাত সংক্রান্ত কর্ম কিংবা তার জাত ও আসমা ওয়াস সিফাতে তথা নাম ও গুণাবলী অথবা উলুহিয়্যাতে (ইবাদতে) কাউকে শরীক করা। শিরক হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে এমন বিষয়ে সমকক্ষ স্থির করা যেটা আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। যেমন- আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা, অন্য কারো নিকট আশা কর।
তাওহীদুল্লাহ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত মানুষের সকল বিশ্বাস, কথা ও কাজে আল্লাহর এককত্বের উপলব্দি ও মেনে চলা। পক্ষান্তরে শিরক হচ্ছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইমাম কুরতুবী বলেন, শিরক হল আল্লাহর নিরঙ্কুশ প্রভূত্বে কারো অংশীদারিত্বের আকীদা পোষণ করা। আক্বীদার পরিভাষায়, শিরক হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও সীমাবদ্ধ কোন বিষয় আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা।
শিরকের ক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, এতে দু‘শরীকের অংশ সমান হওয়া আবশ্যক নয়। বরং শতভাগের একভাগের অংশীদার হলেও তাকে অংশীদার বলা হয়। তাই আল্লাহ তায়ালার হকের সামান্যতম অংশ অন্যকে দিলেই তা শিরকে পরিণত হবে। এতে আল্লাহর অংশটা যতই বড় রাখা হোক না কেন।
শিরকের গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সঙ্গে শরীক করা ক্ষমা করেন না। এটি ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। এবং কেহ আল্লাহর শরীক্ করলে সে এক মহাপাপ আরোপ করে।’ (সুরা, নিসা-৪:৪৮)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তার সঙ্গে শরীক করা ক্ষমা করেন না। এটি ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। এবং কেহ আল্লাহর শরীক্ করলে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়।’ (সুরা, নিসা-৪:১১৬)
জাবির বিন আবদুল্লাহ হতে বর্ণিত, হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘বান্দার জন্য সর্বদাই ক্ষমা রয়েছে যতক্ষন পর্যন্ত হিযাব বা পর্দা পতিত না হয়। বলা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! হিযাব বা পর্দা কি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক্ করা।’ (মুসনাদে আহমদ, ইবনু কাছীর ১ম খন্ড ৬৭৮পৃঃ)
শিরক করলে জান্নাত হারাম এবং জাহান্নাম অবধারিত, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বনী ইসরাইল ! তোমরা আমার রব এবং তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদত কর। কেউ আল্লাহর শরীক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবশ্যই হারাম করবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম।’ (সূরা, মায়েদা-৫:৭২)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কিছুকে আল্লাহর সাথে শরীক করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, সে জাহান্নামে যাবে।’ (মুসলিম)
শিরকের কারণে আমল বাতিল হয়ে যায়
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই এই ওহী হয়েছে তুমি আল্লাহর সঙ্গে শরীক করলে তোমার আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং অবশ্য তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্থ।’ (সূরা যুমার, ৩৯:৬৫)
সূরা আনফালের ৮৩-৮৭ আয়াতে আল্লাহ তাআলা ১৮ জন নবীর নাম নিয়ে তাদের ব্যাপারে বলেছেন, ‘এটি আল্লাহর হেদায়েত, নিজ বান্দাহদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি এটি দ্বারা সৎপথে পরিচালিত করেন। তারা যদি শিরক্ করতো তবে তাদের কৃতকর্ম নিস্ফল হতো।’ (সূরা, আন‘আম-৬:৮৮) মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘আমি তাদের আমলের প্রতি মনোনিবেশ করব, অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধুলিকনায় পরিণত করে দেব।’ (সূরা, ফোরক্বান-২৫:২৩)
শিরকি কাজের ভয়াবহতা
শিরকের পরিণাম ভয়াবহ। এটি মানুষের চূড়ান্ত ধ্বংস ডেকে আনে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক চরম যুলম।’ (সূরা, লুকমান ৩১:১৩) ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল সবচেয়ে বড় গোনাহ কোনটি?’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, অথচ আল্লাহই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সহীহ বুখারী, মুসলিম)
শিরককারীর ধ্বংস অনিবার্য
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে কেউ আল্লাহর শরীক করে সে যেন আকাশ থেকে পড়ল, কিংবা বায়ু তাকে উড়িয়ে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করলো।’ (সূরা, হাজ্জ ২২:৩১) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘যারা আল্লাহর সঙ্গে অপর ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে, সুতরাং শিগগিরই ওরা (মুশরিকরা) এর পরিণতি জানতে পারবে।’ (সূরা, হিজর ১৫ঃ৯৬)
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন- ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বস্তু থেকে বেঁচে থাকবে। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সেগুলো কি? রাসুল (সা.) বলেলেন, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা এবং জাদু।’ (বুখারী ও মুসলিম)
শিরককারী ব্যক্তি অপবিত্র থাকে
ইরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয়ই মুশরিকরা অপবিত্র। (সূরা, তাওবাহ-৯:২৮) মুশরিকদের জন্য দোয়া করা যাবে না-
আল্লাহ তায়ালা বলেন, আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও মু‘মিনদের সংগত নয়, এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামী।’ (সূরা, তাওবাহ ৯:১১৩)
শিরিককারী সর্ব নিকৃষ্ট ব্যক্তি
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘আহলে কিতাব ও মুশরিক কাফেররা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম।’ (সূরা,বাইয়্যেনাহ ৯৮:৬) শিরক করলে ঈমানদার ও কাফের-মুশরিকে পরিণত হয়ে যায়। ঈমান আনার পরেও কেউ যদি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে তবে সে কাফের এবং মুশরিক হয়ে যায়। ইসলামী শরীয়া অনুযায়ী তাকে ‘মুর্তাদ’ বলা হয়। তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
শিরক মানবতার জন্য অবমাননাকর
মানুষের সম্মানকে ধূলায় লুন্ঠিত করে ও তার সামর্থ্যকে নিচু করে দেয়। তার মর্যাদাকেও নিচু করে দেয়, কারণ আল্লাহ পাক মানুষকে খলীফা হিসেবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং তাকে সম্মানিত করেছেন এবং তাকে সমস্ত নাম শিখিয়েছেন। তার অনুগত করে দিয়েছেন; যা কিছু আছে আসমান ও যমীনে, তাকে এই জগতের সকলের উপর নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু সে তার অবস্থাকে ভুলে গেছে। ফলে সে এই জগতের কোন কোন জিনিসকেও ইলাহ ও মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। তার কাছে নিজেকে ছোট করে এবং অপমানিত হয়।
অথচ যাকে আল্লাহ মানুষের খেদমতের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ঝাঁক ধরে বসে আছে। তাদের কাছে নিজেদের প্রয়োজন নিবেদন করছে। অথচ তারাও তাদের মতই আল্লাহ পাকের দাস। না নিজেদের জন্য তারা কোন উপকার করতে পারে; না ক্ষতি করতে পারে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে ডাকে তারা এতটুকুও জিনিস সৃষ্টি করে না, বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। মৃতরা কখনই জীবিতদের সমান নয় এবং তারা জানে না কখন তাদেরকে কবর থেকে উঠানো হবে।’ (সুরা নহল ২০)
অধুনা সমাজের কুসংস্কার
যেখানে শিরক চলতে থাকে সেখানে নানা ধরনের কুসংস্কার ও ভয় প্রকাশ পেতে থাকে কোনো প্রকাশ্য কারণ ছাড়াই। আল্লাহ পাক এই সম্বন্ধে বলেন, ‘যারা কুফরী করে আমি তাদের অন্তরে ভয়কে নিক্ষেপ করব। ওই কারণে যে তারা আল্লাহর সাথে শিরক করছে, আর যে সম্বন্ধে আল্লাহ পাক কোনো প্রমাণ পাঠাননি। তাদের ঠিকানা আগুন এবং জালেমদের জন্য সেটা কতই না নিকৃষ্ট জায়গা।’ (সুরা আল ইমরান ১৫১)
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-