জসীম উদ্দিন, যুগান্তর •
রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)।
সংগঠনটির প্রধান আতা উল্লাহ জনুনিই রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঘটনার আগেই আতা উল্লাহর পরিবারসহ অর্ধশত আরসা নেতার পরিবার গোপনে মিয়ানমার পাড়ি দিয়েছে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর রোহিঙ্গাদের আস্থা হারিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ও গভীর সংকটে পড়েছে আরসা। এ অবস্থায় মুহিবুল্লাহর খুনিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তথ্য ফাঁস করে দিতে পারে-এমন আশঙ্কায় হত্যার মিশনে অংশ নেওয়া সবাইকে মেরে ফেলতে সংগঠনটির আরেকটি গ্রুপকে নির্দেশ দিয়েছেন আমির আতা উল্লাহ জনুনি। বিষয়টি জানতে পেরে নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ ও হত্যার দায় স্বীকার করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছেন হত্যা মিশনে অংশ নেওয়া একজন আরসা সদস্য। রোহিঙ্গাদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তার পাঠানো একটি অডিও ক্লিপ হাতে এসেছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন এমন একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আরসা নেতা আতা উল্লাহ জনুনির নির্দেশে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে-এ ধরনের তথ্য আমরাও পেয়েছি। তবে তথ্যগুলো গভীরভাবে আরও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১২ দিন পার হলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কেউ এখনো গ্রেফতার হয়নি। তবে সন্দেহভাজন ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের মধ্যে ইলিয়াস নামে এক রোহিঙ্গা হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। ইলিয়াস আরসার সক্রিয় সদস্য।
নাম প্রকাশ না কারার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, আরসা নেতা আতা উল্লাহ যে মিয়ানমার সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছে, সেটি জেনে গিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। তিনি রোহিঙ্গাদের আরসা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতেন। এছাড়া আতা উল্লাহ ক্যাম্পে থাকা আরসার দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে একাধিকবার মুহিবুল্লাহকে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন। এতে রাজি হননি তিনি। এসব কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের একটি সূত্র দাবি করেছে, যেসব আরসা নেতা মিয়ানমার সরকারের পক্ষে কাজ করছেন বলে ইতোমধ্যে জানাজানি হয়েছে, তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গোপনে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অর্ধশত পরিবারকে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জান্তা সরকারের সঙ্গে আরসা নেতা আতা উল্লাহর গভীর সম্পর্কের এটি একটি উদাহরণ। বর্তমানে এসব পরিবার সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। আতা উল্লাহর নির্দেশে ৯ মে দুপুর ১২টার দিকে ক্যাম্প-৯, ব্লক সি-৯, এফসিএন-১১৩৮৩০-এর ইলিয়াছ, বাবা শরীফ হোসেনসহ পরিবারের ৮ সদস্য; আবদুর রহমান, বাবা কালামিয়াসহ ৪ জন; পালংখালির ক্যাম্প-১৬ (শফিউল্লাহকাটা)-এ বসবাসরত কামাল মোস্তফার (৪০) (ব্লক-এ/১ ঘর-৯৭৫, এফসিএন-২৪৬৭০৯) পরিবারের ৯ সদস্য; বালুখালী-১ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প-৯, ব্লক-সি-১৩-এর আবদুর রহমান, বাবা কালা মিয়াসহ পরিবারের ৫ সদস্য মিয়ানমার চলে যান। এর দুইদিন পর ১১ মে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ক্যাম্প-১৪ (হাকিমপাড়া) ব্লক-বি-১-এ রোহিঙ্গা অছিউল্লাহ (ঘর-৩৯৬ এফসিএন-২১১৩৮০), বাবা হোসেন এবং আয়েশা বেগম, বাবা অছিউল্লাহ ব্লক-বি (ঘর-৩৯৭ এফসিএন-২১১৩৭৯) পরিবারের ৮ সদস্য এবং ১৬ মে রাত ১০টার দিকে ক্যাম্প-১৬ (শফিউল্লাহকাটা) ব্লক-এ-৪-এ, ঘর-৫৮৪-এর রোহিঙ্গা আয়ুব, বাবা হাফিজুর রহমানসহ পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে গোপনে মিয়ানমার চলে যান। তবে সবার আগে ২৪ মার্চ রাতে সপরিবারে মিয়ানমারে চলে যান আরসার আমির আতা উল্লাহর ডান হাত হিসাবে পরিচিত ক্যাম্প-১৬ শফিউল্লাহকাটার সাবেক সি-ব্লকের হেড মাঝি নুরুল কবির। রোহিঙ্গারা বলছেন, এসব পরিবার মিয়ানমারে খুব সুখে শান্তিতে রয়েছে। সব পরিবারকে জান্তা সরকার চাষাবাদের জন্য জমিজমা ও সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত সোমবার বলেন, ক্যাম্প থেকে কোনো রোহিঙ্গা পরিবার মিয়ানমারে চলে গেছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। তিনি বলেন, মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-১৪) পুলিশ সুপার নঈমুল হক সোমবার বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান রয়েছে। ক্যাম্পে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-