সাহাদাত হোসেন পরশ, সমকাল •
রাত হলেই কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করছে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ। দিনে ক্যাম্পগুলো ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা থাকলেও সন্ধ্যা নামার পরপরই মিয়ানমারের রোহিঙ্গাভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তৎপরতা শুরু করে। এই গ্রুপের অনেকের হাতে ভারী অস্ত্রও রয়েছে।
ক্যাম্প ঘিরে বৈধ-অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় অনেক সময় এসব গ্রুপ খুনোখুনি ও সংঘর্ষে জড়ায়। মাঝেমধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলেও মুহিবুল্লার মতো জনপ্রিয় নেতাকে হত্যার পর সাধারণ রোহিঙ্গারা এক ধরনের চাপা আতঙ্কে রয়েছেন। নিজ দেশে প্রত্যাবাসন নিয়েও অনেকে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। আবার অনেকে এই হত্যার জের ধরে আগামীতে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিরও আশঙ্কা করছেন।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াসহ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুহিবুল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।
মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন, মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের একটি পতাকাতলে আনতে সমর্থ হন। রোহিঙ্গাদের নিজ মাটিতে ফেরানোর স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন। সর্বশেষ মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের সমস্যার কথা তাদের বোঝাতে সক্ষম হন। তার মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতার কারণে ক্যাম্প ঘিরে আরসাসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ আতঙ্কিত ছিল। তার হত্যার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র গ্রুপগুলো তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃতি ঘটাতে পারবে।
মুহিবুল্লাহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিষয়গুলোর সমাধান চেয়েছেন, যা সশস্ত্র সংগঠনগুলোর অবস্থানের বিরুদ্ধে ছিল। তাকে হত্যার ফলে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন, গণহত্যার বিচার করার যে দাবি, তাদের ফিরে যাওয়ার যে প্রত্যাশা তা কিছুটা হলেও হোঁচট খাবে। সশস্ত্র ও চরমপন্থি সংগঠনগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে আসতে পারে।
কক্সবাজারের ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাইমুল হক বলেন, আরসা ও আল-ইয়াকিন বলে কোনো সশস্ত্র সংগঠনের কার্যক্রম ক্যাম্প ঘিরে নেই। তবে অনেক দুষ্টু লোক নিজেদের আরসা ও আল-ইয়াকিনের সদস্য বলে পরিচয় দেয়।
নাইমুল হক আরও বলেন, এক জায়গায় একসঙ্গে এতো লোক বসবাস করলে সেখানে সামাজিক নানা অপরাধ বেশি হবে- এটা স্বাভাবিক। তবে আমাদের নজর সেখানে আছে। যেসব অপহরণের ঘটনা ক্যাম্পে ঘটে তার অধিকাংশ সাজানো।
দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখেন এমন অন্তত তিনজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সমকালকে জানান, এক জায়গায় এত সংখ্যক রোহিঙ্গা একসঙ্গে বসবাস করলে স্বাভাবিকভাবে সেখানে নানা ধরনের ঝুঁকি থাকে। রোহিঙ্গা অনেককে কেউ কেউ ভুলপথে চালিত করতে চায়। সন্ত্রাসী গ্রুপ ছাড়াও উগ্রপন্থিদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করে। তাদের মধ্যে অনেককে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তারও করেছিল।
আরেকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভাষ্য, মিয়ানমারভিত্তিক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপগুলো যেসব অস্ত্র সাধারণত বেশি ব্যবহার করে তার মধ্যে রয়েছে ওয়ান শুটার গান। ওয়ান ব্যারেলের এই অস্ত্রতে এসএমজি ও একে-৪৭ রাইফেলের গুলি ব্যবহার করতে দেখা যায়। আবার অনেক গ্রুপের কাছে হাতে তৈরি অস্ত্রও রয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে একটি অস্ত্রের চালান ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে জানা যায়, ওই অস্ত্রের গন্তব্য ছিল রোহিঙ্গা ক্যাম্প।
কক্সবাজারের মাঠ পর্যায়ের আরেক কর্মকর্তা বলেছেন, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপের হাতে ওয়ান শুটার গান ছাড়াও অল্পসংখ্যক ৭.৬৫ বোরের পিস্তল ও নাইএমএম পিস্তল রয়েছে। মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর আলামত দেখে তদন্তসংশ্নিষ্টরা বলছেন, অটোম্যাটিক পিস্তল ব্যবহার করেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। এটা না হলে একসঙ্গে এতগুলো গুলি ছোড়া সম্ভব ছিল না। এই হত্যাকাণ্ডকে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর পক্ষ থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। এটা একাধারে যেমন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
সংশ্নিষ্টরা এও বলছেন, কক্সবাজার ঘিরে সরকারের একাধিক মেগা প্রকল্প চলছে। সেখানে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নির্বিঘ্ন রাখা অত্যন্ত জরুরি। দেশি-বিদেশি অশুভ তৎপরতার ব্যাপারে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকার বিষয়টি জোরালোভাবে বিবেচনা নেওয়ার কথা বলছেন অনেকে।
জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন নামে যেসব বাহিনী রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আবদুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, মুন্না, নবী হোসেন ও জকির বাহিনী। ক্যাম্পে প্রায় নিয়মিত হানা দিচ্ছে তারা, গুলিও চালাচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি এনজিও কর্মীরাও শঙ্কিত। কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক বা ক্যাম্প ইনচার্জদের স্থানীয়ভাবে ‘মাঝি’ বলা হয়। তারা সাধারণত ক্যাম্পের যাবতীয় সমস্যা নিরসনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়ে কার্যক্রম সমন্বয় করে।
অভিযোগ উঠেছে, অনেক মাঝিই রোহিঙ্গা অপরাধী চক্রকে সহায়তা করছে।
সশস্ত্র গ্রুপে যারা: ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপে যারা রয়েছে, তাদের অনেকের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলো- মো. আব্দুল্লাহ ওরফে দাদা ভাই, বুলু, সুলতান, নবী হোসেন, সফিক, রফিক, মুর্তজা, হামিদুল্লাহ, আবদুস শুকুর, শরীফ হোসেন, মো. রহমান, সবেদ উল্লাহ, আব্দুল্লাহ, ফয়সাল, মো. সোলাম, হামিদ হোসেন, মুহিবু রহমান, দিলদার, আবু সাইদ, তাহের, ফারুক, মুক্কুস, জুবায়ের, মুস্তফা, আব্দুল্লাহ আইদি, হাসন শরীফ, আব্দুল জলিল, হাফেজ উল্লাহ, আরমান খান, আইয়ুব, আমির হোসেন, নুর ইসলাম, আলী আকবর, কামাল, জাইবু রহমান, নাজিমুদ্দিন, সোনা উল্লাহ ও আরাফাত। একটি তালিকায় বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপে জড়িত এমন দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর নাম রয়েছে।
অপরাধ কার্যক্রম: ক্যাম্প ঘিরে সক্রিয় এসব সশস্ত্র গ্রুপের অপরাধ তৎপরতার মধ্যে রয়েছে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়। এ ছাড়া ইয়াবা ও অস্ত্র কারবারের নিয়ন্ত্রণ করে অনেকে। আবার নারীদের জিম্মি করে অনৈতিক কাজে জড়াতে বাধ্য করে সশস্ত্র গ্রুপের অনেক সদস্য। সাধারণ রোহিঙ্গাদের অন্য খানে পাচার করেও অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এসব বাহিনী। এসব সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযানে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর গুলির ঘটনাও ঘটেছে।
২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর নয়াপাড়া ক্যাম্পের পাশে একটি সশস্ত্র গ্রুপের আস্তানায় অভিযানে গেলে র্যাবের ওপর গুলি চালায় একটি বাহিনী। এতে কক্সবাজার র্যাব-১৫-এর সিপিসি-২ হোয়াইক্যং ক্যাম্পের সদস্য সৈনিক ইমরান ও করপোরাল শাহাব উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। চলতি বছরের জুলাইয়ে টেকনাফ থেকে সিএনজিচালিত অটোচালক মাহমুদুল করিমকে অপহরণ করে তার পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
মাহমুদুলের পরিবারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হলেও তাকে জীবিত পাওয়া যায়নি। পরে বন বিভাগ জঙ্গল পরিস্কার করতে গেলে একটি কঙ্কাল দেখতে পায়। সেই কঙ্কালের পরনের পোশাক দেখে তাকে মাহমুদুল করিম হিসেবে চিহ্নিত করে তার পরিবার। ওই ঘটনায়ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো জড়িত বলে জানা যায়। এ ছাড়া রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে ফোন করে চাঁদাও দাবি করা হয়। জানা যায়, কাপড় ব্যবসায়ী নুর নবীর কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-