সাহাদাত হোসেন পরশ •
ইয়াবা, ফেনসিডিল ছাড়াও দেশে নতুন মাদক হিসেবে আইস ও এলএসডির বিস্তার ঘটছে। কোনোভাবেই মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দেশে এগুলোর উৎপাদন না হলেও প্রতিবেশী দেশ থেকে তা ঢুকছে অবাধে।
করোনাকালেও নানা কৌশলে সীমান্ত থেকে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সব প্রান্তে।
আর এখন কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প হয়ে উঠছে মাদক কারবারিদের ‘সেফ জোন’। সমুদ্রপথে বড় বড় চালান আনার পর তা প্রথমে ক্যাম্পের নিরাপদ জায়গায় নেওয়া হয়।
দেশে এভাবে মাদকের রমরমা কারবার চললেও, ঝিমিয়ে পড়েছে মাদকবিরোধী অভিযান। আর এর প্রভাব পড়েছে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের মতো মাদক জব্দ ও মামলায়। কমছে মাদক জব্দ ও আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যা।
চলমান পরিস্থিতিতে নতুন কৌশলে মাদকবিরোধী অভিযান কীভাবে আরও জোরালোভাবে শুরু করা যায়, এ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা চলছে। আর মাদক কারবারে অনলাইনকেন্দ্রিক প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
মাদকবিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত কক্সবাজারসহ দেশের একাধিক জেলার মাঠ পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানান, দেশে ইয়াবার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ ইয়াবার মার্কেট সবচেয়ে বড়। মিয়ানমার থেকে আসে ছোট্ট ইয়াবার বড়ি। এক সময় নাফ নদ দিয়ে বেশি চালান এলেও এখন বদলেছে রুট। এখন সমুদ্রপথ ও পাবর্ত্য এলাকা হয়ে অধিকাংশ চালান ঢুকছে।
১০ বছরের বেশি সময় মাদকবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলন, তিনটি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে মাদক দমন করা সম্ভব নয়।
এগুলো হলো- মাদক কারবারের অর্থনৈতিক চেইন বন্ধ করা। বিভিন্ন অভিযানে বাহকসহ ছোট কারবারি ধরা পড়লেও অর্থ বিনিয়োগকারী ও রাঘববোয়ালরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তৃতীয়ত, টেকনাফ বন্দর হয়ে বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে মাদকের অর্থ লেনদেন হয়।
মূলত টেকনাফ থেকে বার্মিজ কাপড়, আচার, কাঠ ও পেঁয়াজ আসে। এর সঙ্গে মাদকও আনা হয়। তার মত হলো, ইয়াবার স্রোত বন্ধ করতে হলে প্রয়োজনে মিয়ানমারের বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে।
মিয়ানমার থেকে স্থায়ীভাবে গরু আমদানিও বন্ধ করা দরকার। কারণ এসব গরু বিক্রির অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে মাদক কারবারে ব্যবহার হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, মাদক জব্দ ও মামলার সংখ্যা কমছে। ২০১৭ সালে মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকায় গ্রেপ্তার করা হয় এক লাখ ২৫ হাজার ৬৫১ জনকে। ২০১৮ সালে এক লাখ ৪৭ হাজার ৮০৩ জন, ২০১৯ সালে এক লাখ ৫০ হাজার ১৭৫ জন, ২০২০ সালে ৯৯ হাজার ৯৮৫ জন। আর চলতি বছরের প্রথম আট মাসে গ্রেপ্তার হয়েছে ৬০ হাজার ৩৫৬ জন।
২০১৭ সালে দেশে ইয়াবা জব্দ হয় দুই কোটি ৫৯ লাখ ৮৯ হাজার ৪২টি, ২০১৮ সালে তিন কোটি ৬৯ লাখ ৪৭ হাজার ৮২২টি, ২০১৯ সালে দুই কোটি ৪৯ লাখ ৩৫ হাজার ৯৩টি, ২০২০ সালে তিন কোটি ১০ হাজার ৩৪৮টি এবং চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দুই কোটি ৬১ লাখ ১১ হাজার ১৭৬টি।
২০১৭ সালে ফেনসিডিল জব্দ হয় ৩৯ লাখ ১৮৭ বোতল, ২০১৮ সালে ৩৩ লাখ ৯ হাজার ৮২৮ বোতল, ২০১৯ সালে ৩৯ লাখ ২৯ বোতল, ২০২০ সালে ৪৬ লাখ আট হাজার ৪৩৪ বোতল এবং চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ১৯ লাখ চার হাজার ৮৫৯ বোতল।
আগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত চিহ্নিত মাদকের স্পটে ব্লক রেইডসহ গোপন অভিযান চালাতে দেখা যেত। এখন মিরপুর, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পসহ ঢাকার বস্তি এলাকায় মাদক স্পটে কার্যকর তেমন কোনো অভিযান নেই।
সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক মোকাবিলায় কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা ক্যাম্প এক ধরনের বড় চ্যালেঞ্জ। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচশ রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে নতুন-পুরোনো রোহিঙ্গা রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে শীর্ষ মাদক কারবারির তালিতায় রয়েছে ১৩ নম্বর ক্যাম্পের সি-২ ব্লকের আবদুল গফুর ওরফে আব্দুল্লাহ, একই ক্যাম্পের সি-৩ ব্লকের আবুল বাশার, ট্যাংখালি ক্যাম্পের হাফিজুর রহমান ও শামসুল আলম। এ ছাড়া পুরোনো রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ শীর্ষ মাদক কারবারির তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দারা। তাদের অধিকাংশ এখন ক্যাম্প ছেড়ে টেকনাফ ও কক্সবাজার এলাকায় বাঙালি পরিচয়ে বসবাস করছে।
রোহিঙ্গাদের মাদক কারবার সম্পর্কে কক্সবাজার এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, গত বছর মাদক কারবারে জড়িত থাকায় কক্সবাজার এলাকা থেকে ২২১ বাংলাদেশি নাগরিক গ্রেপ্তার হয়। আর সে সময় কক্সবাজারে মাদক কারবারি হিসেবে গ্রেপ্তার হয় ১০৫ রোহিঙ্গা।
সংশ্নিষ্ট এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, মাদক কারবারে এক যুগের বেশি সময় ধরে কোটি কোটি টাকা অর্থ লগ্নি করছেন এমন এক রাঘববোয়ালের নাম সম্প্রতি বেরিয়ে এসেছে। তার নাম মো. মুস্তাক। তিনি মূলত মিয়ানমারের নাগরিক। বর্তমানে বসবাস করছেন সৌদি আরবে। মুস্তাক বাংলাদেশি একটি চক্রের সঙ্গে মিলেমিশে মাদক কেনাবেচায় অর্থ লগ্নি করে আসছেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকার সৌদি প্রবাসীদের তালিকা বাংলাদেশি এজেন্টের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন মুস্তাক। এরপর প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠাতে চাইলে ইয়াবা কেনাবেচার টাকা থেকে তা দেশে তাদের পরিবারের সদস্যদের পরিশোধ করে মুস্তাকের এজেন্টরা। এর বিনিময়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নেন মুস্তাক। পরে প্রবাসী আয় অবৈধ চ্যানেলে মাদক কারবারে ঢুকে যাচ্ছে।
অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থানরত মো. শরীফ সহায়তা করেছেন মুস্তাককে। তিনিও এক সময় সৌদি আরবে ছিলেন। মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে শরীফ বর্তমানে কারাগারে থাকলেও মুস্তাকের কারবার বন্ধ হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ইয়াবা ও আইসের মতো মাদক নির্মূল না করার পেছনে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের একগুঁয়েমি ও খামখেয়ালি দায়ী। মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে ইয়াবার বড় বড় কারখানা থাকলেও তারা বিভিন্ন সময় কুযুক্তি দিয়ে মাদকের ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্বের বিষয়টি এড়ানোর অপচেষ্টা করে আসছে।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় যুক্তি দেয়- ইয়াবা তৈরির মূল কাঁচামাল সিউডোফেড্রিন প্রতিবেশী দেশ থেকে তাদের সেখানে যায়। তবে ইয়াবা তৈরির এই কাঁচামাল ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। এক কেজি সিউডোফেড্রিনের বাজারমূল্য প্রায় ৫০ ডলার।
সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবার পাশাপাশি মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে দেশে ঢুকছে আইস। ইয়াবার তুলনায় ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী ও ভয়ংকর আইসের পূর্ণ নাম ক্রিস্টাল মিথাইল অ্যামফিটামিন। চাহিদা বেশি ও বাজারমূল্য বেশি হওয়ায় মাদক কারবারিরা ইয়াবার পাশাপাশি আইসের দিকে ঝুঁকছে। ইয়াবার কারবারিরাই এখন আইস সরবরাহেও যুক্ত।
২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়। ওই সময় ‘বন্দুকযুদ্ধ’কে মাদক নির্মূলের সমাধান ও শেষ ভরসা ভাবা হয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে সেই ভুল ভাঙে।
মাদকের বিস্তার নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষণা করেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ইমদাদুল হক। তিনি বলেন, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে গ্রেপ্তারের পর থেকে নীতিনির্ধারকরা মাদকবিরোধী অভিযানের পরিস্থিতি নতুনভাবে পর্যালোচনা করছেন। ওই ঘটনার পর মাদকবিরোধী অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এখন সরকারের পরবর্তী স্ট্র্যাটেজি কী হবে সেটা দেখতে হবে।
অধ্যাপক ইমদাদুল আরও বলেন, মাদক নির্মূলে মিয়ানমারের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। তারা অজুহাত দিয়ে বাস্তব চিত্র আড়ালের চেষ্টা করে আসছে। তবে তাদের সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া দেশটির সীমান্তের ভেতরে ইয়াবার কারখানা চালু থাকার প্রশ্নই আসে না।
ঢাকা মহানগরের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, স্কুপ, আইস নিয়মিতই ধরা পড়ছে। ‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে কারবার করায় অনেক সময় সবাইকে ধরা সম্ভব হয় না।
তবে কারও ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য পেলে অভিযান চালানো হয়। পাশাপাশি সাপ্লাই চেইন ভেঙে দেওয়া, মাদকসেবীদের সুপথে আনতে চিকিৎসাসহ সার্বিক প্রক্রিয়ায় পরিবার ও সমাজের বড় ভূমিকা রয়েছে।
কক্সবাজারের র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, মাদক মোকাবিলায় সবার আগে এর সঙ্গে জড়িতদের অর্থনৈতিক চেইন ভেঙে দিতে হবে। এটা না পারলে অভিযান চালিয়েও মাদক নির্মূল করা কষ্টসাধ্য হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি অভিযানও জোরালো করতে হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-