উখিয়ার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা, আসামিদের শেষ রক্ষা হলো না

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অফিসিয়াল ফেসবুক পাতায় “শেষ রক্ষা হলো না”

শীর্ষক লেখাটিতে ৪ বছরের নিষ্পাপ শিশু সুমাইয়া হত্যাকান্ড। মায়ের সহযোগিতায় ঘাতক সৎপিতা কর্তৃক যে অমানবিক আচরণ এবং কোন অপরাধী যে পালিয়ে বাঁচতে পারে না এই বিষয়টির পুরোপুরি সকলের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা হলো-

অবশেষে শিশু সুমাইয়া আকতার মীম প্রকাশ সুমা আকতার হত্যা মামলায় দীর্ঘদিন পলাতক ঘাতক সৎপিতা এবং সহযোগিতার জন্য মা গ্রেফতার হয়েছে। হত্যার দায় স্বীকার করে বিজ্ঞ আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেছে।

চার বছরের একটি মেয়ে শিশু সুমাইয়া আক্তার মীম প্রকাশ সুমা আক্তার। সে তার মা বুলবুল আক্তার (২৫) এবং সৎ পিতা নুরুল হক (৩৫) এর সাথে উখিয়া উপজেলার ৩নং হলদিয়াপালং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের পূর্ব মরিচ্যা কাঠালিয়া এলাকায় মোস্তফা জাবেদ এর টিনের কলোনিতে ছোট্ট একটা রুমে ভাড়া থাকত।

নুরুল হক মেয়েটির সৎপিতা হলেও ছোট্ট সুমাইয়া তাকে আব্বু বলেই ডাকতো। তখনো তাদের সাথে আশপাশের প্রতিবেশী কারো কোন সখ্যতা গড়ে উঠেনি।

প্রায় দুইমাস এই কলোনিতে ভাড়া থাকা অবস্থায় ঘাতক নুরুল হক তার স্ত্রী বুলবুল আক্তারের সহযোগীতায় শিশুটিকে বিভিন্ন সময়ে অমানবিক নির্যাতন করতে থাকে। কখনো প্লাস্টিকের রশি দিয়ে ঘরের চালের তীরের সাথে উল্টো করে ঝুলিয়ে। কখনো মাথায় আঘাত করে। কখনো গালে কামড় বসিয়ে। আবার কখনো পেটে বা পীঠে ঘুষি মেরে। চলতে থাকে অমানবিক পৈশাচিক নির্যাতন।

এই অসহনীয় ব্যাথায় শিশুটি চিৎকার করে আর্তি জানাতো “আব্বু আমাকে আর মারিও না। আমি তোমার সব কথা শুনবো।

তবুও ঘাতক নুরুল হকের হৃদয় গলেনি কিংবা স্বামীর নেশায় মত্ত থাকা মা বুলবুল আক্তারের মন গলেনি।

গত ১৫ এপ্রিল মাহে রমজানের ২য় দিন সকাল থেকে শিশু সুমাইয়া(৪) কে না খাইয়ে রাখে। এমনকি পানি পর্যন্ত খেতে দেওয়া হয়নি৷ একই দিন বিকাল ৪টার দিকে শিশুটির উপর শুরু করে অমানবিক নির্যাতন। প্লাস্টিকের রশি দিয়ে বেধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। সেই সাথে ঘাতক নুরুল হক এর ঘুষির আঘাত। অতিরিক্ত ব্যাথায় নির্বোধ সুমাইয়া কান্না করার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। একপর্যায়ে শিশুটি অজ্ঞান হয়ে যায়৷ মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য মেয়েটির গলা টিপেও ধরা হয়। একই তারিখ রাত ৯টার দিকে শিশুটি মৃত্যু বরণ করে।

শিশু সুমাইয়ার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর শিশুটিকে ঘরের মেঝেতে পাটির উপর শুইয়ে কম্বল চাপা দিয়ে ঘর তালাবদ্ধ করে ঘাতক সৎপিতা নুরুল হক এবং মা বুলবুল আক্তার সেহেরীর পর রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়।

পরদিন সকাল ১০ টা সাড়ে দশটার দিকে পাশের রুমের ভাড়াটিয়া রোজিনা আক্তার সুমাইয়াদের ঘরে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা তালাবদ্ধ দেখে পাশের রুম থেকে পার্টিশন বেড়ার উপর দিয়ে দেখে শিশু সুমাইয়ার নিথর দেহ কম্বল চাপা অবস্থায় বিছানার উপর পড়ে আছে৷ এই দৃশ্য দেখে রোজিনা হাউ-মাউ করে চিৎকার দিয়ে উঠে।

রোজিনার চিৎকার শুনে পাশের দোকানের মতি মিয়া দৌড়ে আসে। ততক্ষণে আশপাশ থেকে আরো অনেক মানুষ এসে ভিড় জমায়৷ রোজিনার কথা শুনে সবাই দরজা ভেঙে দেখে ঘরের মেঝে পাটির উপর কম্বল চাপা অবস্থায় শিশু সুমাইয়ার নিথর দেহ দেখতে পায়।

পরে এলাকায় জানাজানি হলে স্থানীয় ইউপি সদস্য ঘটনাস্থলে এসে বিস্তারিত উখিয়া থানা পুলিশকে জানায়।

খবর পেয়ে উখিয়া থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে লাশের সুরতহাল সম্পন্ন করে। ময়না তদন্তের জন্য মৃতদেহ কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে।

আশপাশের মানুষের কাছে ভিকটিমের পিতা-মাতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে কেহ কোন তথ্য দিতে পারেনি৷ বাড়ি ওয়ালা ভাড়াটিয়ার তথ্য সংরক্ষণ করে রাখেনি। ময়না তদন্ত শেষে স্থানীয় জনগণ শিশুটির দাফন কাফন সম্পন্ন করে।

ঘটনার ৪ দিনপর উখিয়া থানা পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত নামা আসামির কথা উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা রুজু করে।

দ্বিতীয়দিন পুনরায় ঘটনাস্থলটি পুংখানুপুংখভাবে পরিদর্শন কালে ঘরে একটি সিম কভার খুজে পাওয়া যায়৷ উক্ত কভারের ভেতর থাকা মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে আসামীদের পরিচয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। আসামীদের বাড়ি ভিন্ন এলাকা। ভাসমান অবস্থায় ঘোরাঘুরি এবং ঘনঘন অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছিলো না।

ঘটনার ৪ মাস পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সুমাইয়ার মামার সন্ধান পাওয়া যায়। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে অবহিত করিয়া উখিয়া থানার একটি চৌকস টিম রামু থানাধীন গর্জনীয়া এলাকায় গিয়ে কৌশল অবলম্বন করে আসামীদের অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকে।

দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর আসামীরা গর্জনীয়া বাজারে পৌছামাত্র তাদেরকে ধৃত করতে সক্ষম হয়।

কয়েক দফা ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে শিশু সুমাইয়া আক্তার মীম প্রকাশ সুমা আক্তার (৪) কে নির্মম নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠে। এক পর্যায়ে গ্রেফতারকৃত আসামীরা সুমাইয়া (৪) হত্যা করার কথা স্বীকার করে। তাদের নিজেদের দায় স্বীকার করে ৩০/০৮/২০২১ বিজ্ঞ আদালতে জবানবন্দি প্রদান করে।

ঘটনার পর থেকে তারা কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, চকরিয়া, লোহাগড়া ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পুলিশের তৎপরতায় গ্রেপ্তার হয়ে তারা এখন বিজ্ঞ আদালত হয়ে জেলখানায়।

আরও খবর