হুমায়ুন কবির জুশান, উখিয়া •
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা মানবতার শহর উখিয়ায় সক্রিয় রয়েছে নানা অপরাধী চক্র। পর্যটন নগরী কক্সবাজারে অবস্থান করছেন দেশি-বিদেশি নাগরিকরা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সেবাদানকারি এনজিওতে কর্মরত রয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন।
উখিয়ায় বিচরণ করছেন নানান রকমের মানুষ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন প্রায় এগারো লাখের মতো রোহিঙ্গা মুসলিম। নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে ৩৪ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছেন তারা। লাখ লাখ রোহিঙ্গার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। গতি হারাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশও। ফলে উদ্ভুত এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার আন্তর্জাতিক মহলে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে আপ্রাণ চেষ্ট চালিয়ে যাচ্ছে।
এখানে রোহিঙ্গারা ইয়াবা পাচারসহ নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তারা প্রতিনিয়ত গ্রেফতার হচ্ছে।
তাছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক কক্সবাজার ও উখিয়া-টেকনাফে সক্রিয় রয়েছে নারী ও শিশু পাচারকারী। মাদক চোরাকারবারীরা এখানে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। চরম দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করছেন স্থানীয়রা।
সুশাসনের জন্যে নাগরিক সুজনের উখিয়ার আহবায়ক সাংবাদিক নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, উখিয়ার আগের পরিবেশ এখন আর নেই। দেশজুড়ে সীমান্ত উপজেলা উখিয়া-টেকনাফে ইয়াবার দুর্নাম রয়েছে। তার ওপর রোহিঙ্গাদের কারণে পরিবেশ মারাত্নক ক্ষতি হয়েছে। এনজিওতে নারী-পুরুষের অবাধ চলাফেরা ও নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাছাড়া উখিয়া-টেকনাফে পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
গৃহিনী হুমাইরা আক্তার বলেন, আমি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে কোটবাজার যাচ্ছিলাম। মরিচ্যা ষ্টেশন থেকে সিএনজিতে ওঠা মাত্রই পেছনের সীটে ওঠে বসেন এক যুবক। কিছুক্ষণ পর আরেকজন সামনে গিয়ে বসেন। সিএনজি চলতে থাকে। গুরা মিয়ার গ্যারেজের পাশে সিএনজি হঠাৎ থেমে যায়। সামনে বসা লোকটি বেশ কয়েকটি স্বর্ণের বার দেখিয়ে বিক্রির কথা বলেন। পেছনে বসা লোকটি দাম-দর করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা আমাকে লোভ দেখায়। আমিও তাদের কথায় সরল বিশ্বাসে ব্যাংক থেকে তোলা ১৮ হাজার টাকা ও আমার গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন খুলে নিয়ে নেয়। বিনিময়ে কয়েকটি স্বর্ণের বার আমার হাতে দিয়ে কোটবাজারের একটু আগে যাত্রী দুজন নেমে পড়ে। সিএনজি চালক কোটবাজারে স্বর্ণের দোকানে বিক্রি করে অনেক টাকা পাব বলে আমাকে আশ্বস্থ করতে থাকে। আমি সিএনজি থেকে নেমে স্বর্ণের দোকানে বারগুলো বিক্রির কথা বলি। স্বর্ণ দোকানদার এগুলো নকল স্বর্ণ বলে জানায়। বুঝতে বাকি রইল না। আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি। সাধারণ মানুষদের বুঝার অভাব, সরলতা ও অতিমাত্রায় লোভের কারণেই প্রতারকরা সুযোগ পাচ্ছে।
এদিকে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন অন্যজনকে গলা কেটে খুন করে লাশ গুম করতেও দ্বিধা করছে না। রোহিঙ্গাদের মধ্যে একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ বিদ্যমান। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ঘটেছে একের পর এক অপরাধের ঘটনা। ইয়াবা ব্যবসা, সেবনসহ গুরুতর নানা অপরাধ চলছে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে। খালি হাতে এক কাপড়ে আসা রোহিঙ্গারা আর আগের মতো নেই। তারা বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িত। আগে রোহিঙ্গারা ইয়াবা বহন করতো আর এখন রোহিঙ্গারাই ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার ঘটাতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়। সাধারণ রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থানের ফলে ক্যাম্পে হত্যাকান্ডের ঘটনা কমে আসলেও থেমে নেই ইয়াবা ব্যবসা। কক্সবাজার এলাকায় ইয়াবা সহ বিভিন্ন মাদক কারবারে জড়িতদের শতকরা ৮০ ভাগই রোহিঙ্গা শরনার্থী। তারা মায়ানমারের মানুষ হওয়ায় সেই এলাকা ও সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের ধারণা রয়েছে। আবার এখানেও দীর্ঘদিন থাকায় এখানকার পরিবেশ সম্পর্কেও তাদের ধারণা জম্মেছে। ফলে তারা মাদক কারবার সহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়েছে।
র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ গত ৯ জুন সকালে ইয়াবা, স্বর্ণ ও নগদ টাকা উদ্ধার সংক্রান্ত এক প্রেস ব্রিফিং একথা বলেন।
উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ আরো বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে মাদক উদ্ধার করা খুব কঠিন। কারণ রোহিঙ্গারা পাহাড়ি এলাকায় ঘনবসতিপূর্ণ বসবাস করে। ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থীরা সহজে ইয়াবা বহন, মজুদ, কারবারে জড়িয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, মাদক কারবারে রোহিঙ্গারা জড়িত না থাকলে সরকারের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদক কারবার বন্ধে সহজে সফলতা অর্জন করতে পারতো। তবে আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতায় রোহিঙ্গা মাদক কারবারীরা দিন দিন কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। আবার রোহিঙ্গাদের সাথে স্থানীয়রাও মাদক কারবারে জড়িত রয়েছে।
র্যাব-১৫ অপরাধ দমনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও কাজ করছে। যার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সম্প্রতি ৪৫ লক্ষ ইয়াবার একটি বড় চালান র্যাব আটক করতে সক্ষম হয়েছে। সচেতন মহল বলছেন,
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে উখিয়া-টেকনাফে নানা অপরাধী চক্র সক্রিয় রয়েছে। সহজ-সরল রোহিঙ্গাদের নদী পথে মালেশিয়া নেয়ার কথা বলে রোহিঙ্গা নারী ও শিশু পাচার করছে একটি সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্র। ইয়াবা মাদক ব্যবসায় সক্রিয় চোরাকারবারীরা। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে আরেকটি চক্র। স্বর্ণের বার দেখিয়ে প্রতারণা করছে প্রতারক চক্র। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকরির আড়ালে চলছে নানান অনৈতিকতা। সব মিলিয়ে উখিয়ার সেই আগের পরিবেশ আর নেই।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-