এম. বেদারুল আলম •
কক্সবাজারে আর্থিক দৈন্যতাসহ নানামুখী মানবিক সংকটে দিন পার করছে ৫ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারি। করোনাকালীণ সময়ে সংক্রমণ রোধে নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এমতাবস্থায় জেলার ৫শতাধিক কিন্ডারগার্টেন ও এবতেদায়ী মাদরাসার ৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারি মানবেতর জীবন যাপন চলছে।
করোনা মহামারিতে বন্ধ রাখা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেনি এখনও। ফলে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতনও। অসহায়ত্ব জীবন নিয়ে চলছে তাদের সংসার। অনেকে বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন পেশা। দুঃসময়ে হলেও সরকারের কাছে প্রনোদনার দাবি শিক্ষকদের। গত বছরে ইআইআইএন নম্বরধারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য সরকার ৪৬ কোটি টাকার প্রনোদনা দিলেও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা এর বাইরে রয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগী শিক্ষকগণ। এভাবে আরো কিছুদিন চলতে থাকলে শিক্ষক-কর্মচারির পরিবারে মানবিক বিপর্যয় ঘটবে বলেও বিশ্লেষকগণ মত প্রকাশ করেছেন।
বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষকগণের সাথে আলাপ করে জানা যায়, কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকরা নামমাত্র বেতনে চাকরি করেন। বেতনের পাশাপাশি টিউশনি করিয়ে কোনোমতে তাদের সংসার চালাতে হয়। করোনার মধ্যে ৬ মাস ধরে টিউশনিও বন্ধ আছে। তারা পড়েছেন মহাসমস্যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেও কোন সহযোগিতা পায়নি বলে জানান ভুক্তভোগী শিক্ষকগণ।
জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ জানান, সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের গত বছর ও প্রণোদনা দিয়েছন এ বছর দিচ্ছেন। বিভিন্ন অপারেটরের মাধ্যমে মোবাইলে এ সহায়তা প্রদান করেছেন। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা আলাদাভাবে পেয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। তবে স্হানীয়ভাবে কোনো প্রনোদনা এখনো আসেনি। স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকরাও সহযোগিতার আওতায় ছিল বলেও জানান তিনি।
জেলা কিন্ডারগার্টেন স্কুল শিক্ষক পরিষদের সভাপতি সাংবাদিক হুমায়ুন সিকদার জানান, করোনা মহামারিতে ৬ মাস যাবত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকরা মানবেতর জীবনযাপন করে যাচ্ছে। তাদেরকে সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
তিনি বলেন এখনও স্কুল বন্ধ। কবে খুলবে জানা নেই। শিক্ষার্থী নেই। তাই বেতনও নেই শিক্ষকদের। এ অবস্থা কবে ঠিক হবে, তাও বলা যাচ্ছে না। সেই অনিশ্চয়তায় অনেক অভিভাবক পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন।
অসহায় শিক্ষকদের বেতন তো দূরের কথা, বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় স্কুলই বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রতি স্কুলে সবমিলে ১০-১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। তারা বেঁচে থাকতে সরকারের সহযোগিতা চান।
কক্সবাজার কেজি স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক রশিদ আহমেদ জানান, এখনো কেজি স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারিরা কোন সরকারি সহায়তা পায়নি। সরকার নন এমপিও শিক্ষকদের জন্য প্রণোদনা ঘোষনা করলেও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের জন্য কোন সহায়তা বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ফলে তাদের কান্না দেখার কেউ নেই।
এদিকে জেলার ৪ পৌরসভা ও ৭১ ইউনিয়নে কিন্ডারগার্টেন ও এবতেদায়ী মাদরাসা রয়েছে ৫ শতাধিক। কয়েকজন শিক্ষক জানান, কিন্ডারগার্টেনের স্কুলগুলোর বেতন হয় শিক্ষার্থীদের ফি আর টিউশনি থেকে। স্কুল বন্ধ থাকায় ফি আদায় করা যাচ্ছে না। আবার নিষেধাজ্ঞার কারণে টিউশনিও করানো যাচ্ছে না। যে কারণে অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করছেন শিক্ষকরা। কেউ কেউ আয় না থাকায় গ্রামেও পাড়ি জমিয়েছেন। লজ্জায় ত্রাণের জন্য হাত না পাততে পেরে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকে।
শিক্ষকরা বলেন, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে সারাদেশের মতো কক্সবাজার জেলায় কিন্ডারগার্টেনও বন্ধ থাকায় ৫ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অমানবিক অসহায়ত্বের মধ্যে জীবনযাপন করছেন। করোনার এই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে অনেকেই সুযোগ-সুবিধা পেলেও কিন্ডারগার্টেনে স্বল্প বেতনে চাকরি করা শিক্ষকরা কিছুই পাননি বলে জানা যায়।
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক দেশের সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে করে একদিকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবার পাশাপাশি অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক ও শিক্ষকরা। গোটা জেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এছাড়া দেশের শতকরা ৭০ ভাগ কিন্ডারগার্টেন স্কুল পরিচালিত হয় ভাড়া বাড়িতে।
তথ্য মতে, জেলায় ৩৪৬টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। এছাড়া এরমধ্যে দেড় শতাধিক এবতেদায়ী রয়েছে। কর্মরত রয়েছেন ৫ হাজারের বেশি শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বাড়িভাড়া, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালকদের। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে বাড়িভাড়া ও শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ হয়নি দেড় বছরে।
কিন্ডারগার্টেন স্কুল শিক্ষাখাতে অসামান্য অবদান রাখছে। মানসম্মত শৈশব উন্নয়ন ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রেই কিন্ডারগার্টেনের অবদান রয়েছে। সেইদিক বিবেচনা করে করোনা পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর জন্য আর্থিক অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণের দাবিও জানানো হয়।
উল্লেখ্য কক্সবাজার সদরে ৫৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে কক্সবাজার জেলায় ২২টি দাখিল মাদ্রাসা, ৫টি আলিম মাদ্রাসা, ১৩টি মাধ্যমিক ও ১১টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪টি ডিগ্রি কলেজ, ২টি এসএসসি ভোকেশনাল ও ১টি ভোকেশনাল এইচএসসি বিএম (কম্পিউটার) সহ মোট ৫৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী , দেশে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সাড়ে সাত হাজার। করোনায় এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তাই তাঁদের পাশে দাঁড়াচ্ছে সরকার। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের অধীন নন-এমপিও ৮০ হাজার ৭৪৭ জন শিক্ষককে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। আর ২৫ হাজার ৩৮ জন কর্মচারী পাবেন আড়াই হাজার টাকা করে। এ জন্য সরকার ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। নন-এমপিও শিক্ষকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরও এই খাতে একই পরিমাণ বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
জেলার ৫ হাজার কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের চরম কষ্টে দিনাতিপাত করা পরিবারকে একটু স্বস্তি দিতে সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনা জরুরি। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন মানুষ গড়ার কারিগরখ্যাত শিক্ষকগণ।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-