জাগো নিউজ •
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ এড়াতে দেশব্যাপী চলছে কড়াকড়ি। বন্ধ লঞ্চ, ট্রেন ও আন্তঃজেলা গণপরিবহনও। অন্যান্য কার্যক্রমেও আছে বিধিনিষেধ।
কিন্তু এ অবস্থায়ও থেমে নেই মাদক পরিবহন। বিভিন্ন পন্থায় মাদক আনা-নেয়া চলছে প্রতিনিয়ত। জরুরি পণ্য পরিবহনের আড়ালে কয়েক ধাপে খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে তা পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতা অর্থাৎ মাদকসেবীদের হাতে। এমনকি ‘হোম ডেলিভারিও’ হচ্ছে মাদকের। অর্থাৎ করোনাকালে সব কিছু থমকে গেলেও রমরমা কারবার চলছে মাদকের।
গত কয়েক মাসে পুলিশ, র্যাব এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ মাদকদ্রব্যের বড় বড় চালান ধরে। কাঁচামালের আড়ালে, পিকআপ ভ্যানের পাটাতনে, এমনকি অ্যাম্বুলেন্সের ইঞ্জিনের ভেতরেও লাখ লাখ ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে। গ্রেফতারও করা হয়েছে মাদক কারবারিদের। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিযানের মাধ্যমে মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করতে তারা বদ্ধপরিকর।
সরকার ঘোষিত দেশব্যাপী ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ মধ্যে গত ২২ এপ্রিল ‘মুভমেন্ট পাস’ নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে হেরোইন পাচারের সময় র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন সৌমিক আহমেদ সিদ্দিকী নামে এক ব্যক্তি। করোনা মহামারির মধ্যে মাস্ক ও স্যানিটাইজারের আড়ালে প্রাইভেটকারে হেরোইনের চালান নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
এর আগে গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর রামপুরা এলাকা থেকে অভিনব কায়দায় পিকআপ ভ্যানে গাঁজা পরিবহনের সময় দুজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (তেজগাঁও) বিভাগ। অভিনব কায়দায় লুকানো ৫৫ কেজি গাঁজা জব্দ করার পাশাপাশি ওই পিকআপ ভ্যানটিও আটক করা হয়।
গত ২ মে রাতে কক্সবাজার টেকনাফের হ্নীলা চৌধুরীপাড়া চিতা-সংলগ্ন এলাকা থেকে আড়াই লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
গত ৪ মে ইয়াবার বড় চালানসহ একটি চক্রের পাঁচজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। চক্রটি ভাসমান বেদে দলের ছদ্মবেশ ধারণ করে নদীপথে ঢাকায় এসে ইয়াবা পাচার করত। তারা কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসার ক্ষেত্রে মহাসড়ক ব্যবহার না করে বিকল্প হিসেবে গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে বিভিন্ন ইজিবাইক, সিএনজি ও টেম্পো ব্যবহার করে পথ পাড়ি দিত।
সর্বশেষ গত ১৮ মে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার ইয়াবাসহ মাদক কারবারি চক্রের দুই সদস্যকে আটক করে র্যাব। বিশেষ কায়দায় ছোট পলিথিনের পুঁটলি তৈরি করে মুখ দিয়ে গিলে পাকস্থলীতে ইয়াবা বহন করছিল ওই দুজন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলমান মহামারিতে মাদকের চাহিদা বেড়েছে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে অল্প সময়েই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে এসব মাদক। প্রতিনিয়তই রুট বদল করছে মাদক কারবারিরা।
সূত্র বলছে, ইয়াবার নতুন রুট এখন উপকূলীয় অঞ্চলের নৌপথ। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, পাথরঘাটা এবং পিরোজপুরের তেলিখালী হয়ে মোংলা বন্দরে যায় ইয়াবার বড় বড় চালান। আবার কুয়াকাটা-পাথরঘাটা থেকে বরিশাল হয়ে রাজধানীতে ঢোকার জন্য রয়েছে ভিন্ন একটি রুট। এসব নৌপথের প্রতিটিতেই ইয়াবার চালান আনা-নেয়া হয়। পরে তা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জে যায় নৌপথে। একপর্যায়ে ঢাকা শহরের পাশাপাশি সব বিভাগীয় শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে সারাদেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছায় ইয়াবা।
এক হিসাব মতে, দেশে মাদকসেবীর আনুমানিক সংখ্যা প্রায় এক কোটি। প্রতি বছর কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার মাদকের লেনদেন হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা ধরনের নেশাদ্রব্যের সহজলভ্যতার কারণে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম, যা একটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য চরম উদ্বেগজনক। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার প্রকট রূপের পেছনে মাদক একটি বড় উপসর্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খুন, ছিনতাই, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যারা ধরা পড়ছে তারা মূলত মাদক বহনকারী। তবে মূল ব্যবসায়ীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সে কারণে মাদক আইন আরও কঠোর করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উদ্ধার করা মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে- তিন কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার ১৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৭১ দশমিক ৬ কেজি আফিম, ২১০ দশমিক ৪৪ কেজি হেরোইন, ৩ দশমিক ৮৯৩ কেজি কোকেন, ১০ লাখ ৭ হাজার ৯৭৭ বোতল ফেনসিডিল, ১২৯ লিটার মদ, ৫০ হাজার ৭৯ কেজি গাঁজা, ২ হাজার ৩২৭টি গাঁজার গাছ, ১ লাখ ২৪ হাজার ৬০৮টি মাদক ইনজেকশন। ২০২০ সালে মাদক মামলা হয়েছে ৮৫ হাজার ৭১৮টি এবং আসামি গ্রেফতার হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৪৩ জন।
বিজিবি সদরদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে ৭৩৭ কোটি ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার টাকার চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য জব্দ করে বিজিবি। জব্দ মাদকের মধ্যে রয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ৮৯ হাজার ৮৪৯ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬৯ বোতল ফেনসিডিল, ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ বোতল বিদেশি মদ, ৬ হাজার ৩৩৯ লিটার বাংলা মদ, ১০ হাজার ৪১৬ ক্যান বিয়ার, ১৩ হাজার ৮৫৭ কেজি গাঁজা, ২২ কেজি ১৭ গ্রাম হেরোইন, ৪৬ হাজার ৬২১টি উত্তেজক ইনজেকশন, ৬৪ হাজার ১৬৯টি এনেগ্রা/সেনেগ্রা ট্যাবলেট এবং ৩০ লাখ ২৪ হাজার ৯টি অন্যান্য ট্যাবলেট।
র্যাব সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩ মে থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার ৮৫৩ পিস ইয়াবা, ৫ লাখ ২৮ হাজার ৫২১ বোতল ফেনসিডিল, ৪৫ হাজার ১৯৩ কেজি গাঁজা, ২৮ হাজার ৪৪ বোতল বিদেশি মদ, ২৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৩ লিটার দেশি মদ এবং ১৭৭ কেজি হেরোইন উদ্ধার করেছে পুলিশের এ এলিট ফোর্স। তারা আসামি গ্রেফতার করেছে ৪৩ হাজার ৯৩৮ জন।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মতিঝিল জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম সোহাগ বলেন, ‘আমরা দেখেছি- লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে লাশের মতো করে সাজিয়ে ফেনসিডিল বহন করছিল মাদক ব্যবসায়ী। এর কিছুদিন আগে আইন মন্ত্রণালয়ের একটি স্টিকার তৈরি করে তা গাড়িতে লাগিয়ে মাদক সরবরাহ হচ্ছিল। এমনকি পুলিশ লেখা গাড়িকেও আমরা চেক করছি, আসলেও সেখানে পুলিশের কোনো কর্মকর্তা আছেন কি-না।’
ডিএমপির গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ওয়াহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীদের স্বভাব পরিবর্তন হয় এটা নজিরবিহীন। একজন মাদক কারবারি যতবার জেলে যাবে সে ততবারই বের হয়ে একই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়বে। লকডাউনকে কেন্দ্র করে মাদক কারবারি ন্যূনতম কমেনি বরং বেড়েছে। আমাদেরও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বেড়েছে। মাদক কারবারিরা যে উপায়েই মাদক আনুক না কেন, আমরা তাদের আইনের আওতায় সোপর্দ করতে পারব।’
জানতে চাইলে র্যাব-২ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, ‘ঝুঁকি থাকার পরও খুব সহজে এবং বেশি টাকা ইনকামের জন্য কিছু অসৎ ব্যক্তি মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ে। একবার কেউ জড়িয়ে পড়লে জেলে যাওয়ার পরও একই ব্যক্তি বের হয়ে এসে আবারও মাদক কারবারে নেমে পড়ে। অন্যদিকে করোনায় অনেকের আয় কমে গেছে, সে কারণে তারা মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাদকের চাহিদা এত বেশি যে সীমান্ত থেকে একবার ঢাকায় নিয়ে এলে অনেক বেশি দামে বিক্রি করতে পারে তারা। এছাড়া সেবনকারীরাই বিক্রেতাদের অনেকটা পাগল করে দেয় মাদকের জন্য। বিপুল চাহিদা থাকায় এ ব্যবসা শূন্যের কোটায় নামছে না। যারা র্যাব বা পুলিশের কাছে ধরা পড়ছে তারা ভেবেই নিচ্ছে কিছুদিন পরে বের হয়ে আসতে পারবে জেল থেকে। কারণ বাইরে থাকে তাদের গডফাদার। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন ছাড়া মাদকের বিস্তার রোধ করা কঠিন।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘লকডাউন শুরু হওয়ার পরে মাদক কারবারিরা বিভিন্ন পন্থায় মাদক ব্যবসা শুরু করে। লকডাউনে দূরপাল্লার গাড়ি বন্ধের সুযোগে কাঁচামালের ট্রাকে ‘মুভমেন্ট পাস’ নিয়েও কিন্তু মাদক নিয়ে এসেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের টেকনিক ধরে ফেলেছে। এক্ষেত্রে তারাও ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে। আমরা যখন সড়কে বেশি ব্লক দিচ্ছি তখন মাদক কারবারিরা বুঝতে পেরে নদীপথে মাদক বহন করার চেষ্টা চালিয়েছে। যখন তারা দেখছে নদীপথেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা চালাচ্ছে, তখন তারা মুভমেন্ট পাস কিংবা জরুরি প্রয়োজনের স্টিকার গাড়িতে লাগিয়ে মাদক পরিবহনের চেষ্টাও চালিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত র্যাবের হাতে তারা ধরা পড়ে।’
এখন অনলাইনেও মাদক বিক্রি হচ্ছে জানিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘লকডাউনে মাদক কারবারিরা খুচরা ক্রেতা ও সেবনকারীদের বাসায় বাসায় হোম ডেলিভারি দিয়েছিল। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম একটি চক্রকে ধরে ফেলে।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মাদক শুধু একজন ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের জন্যই অভিশাপ বয়ে আনে না, দেশ-জাতির জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনছে। নানারকম প্রাণঘাতী রোগ বিস্তারের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ করে তুলছে। সঙ্গত কারণেই লকডাউনের মধ্যেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে, মাদকের চিহ্নিত বা সন্দেহজনক স্পটগুলোতে সর্বদা নজরদারি রেখে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে র্যাব।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-