শওকত আলী বাবু, বাগেরহাট •
‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’। যিনি হজরত খানজাহান আলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নামেই বেশি পরিচিত। যশোর-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা ও বরিশালের কিছু অংশ নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন একটি রাজ্য। এ রাজ্যের নাম ছিল ‘খলিফাতাবাদ’। হজরত খানজাহান আলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির প্রতিষ্ঠিত রাজ্য নিয়ে লিখেছেন জাগোনিউজের বাগেরহাট প্রতিনিধি শওকত আলী বাবু-
খানজাহান আলীর জন্ম ও পরিচয়
খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান। তিনি ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আকবর খাঁ এবং মাতার নাম আম্বিয়া বিবি। পিতার কাছেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।
শিক্ষা গ্রহণ
পিতার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি দিল্লীর বিখ্যাত ওলিয়ে কামেল পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর (রাহ.) কাছে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। শিক্ষাজীবনে তিনি কুরআন, হাদিস, ও ইলমে ফিকহ শাস্ত্রের উপর গভীর জ্ঞানার্জন করেন।
কর্ম জীবন
শিক্ষা জীবন শেষ করার পর হজরত খানজাহান আলী সে সময় তুঘলক সেনাবাহিনীতে কর্মজীবন শুরু করেন। অতি অল্প সময়েই তিনি প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন।
তারপর ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৬-২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গভর্ণর) পদে যোগদান করেন।
ইসলামের খেদমত ও রাজ্য প্রতিষ্ঠা
পরবর্তী সময়ে হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচারে বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে বর্তমান বাগেরহাটে এসে পৌছেন। এবং সেখানে তিনি জনকল্যাণে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়ে যশোর-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা ও বরিশালের কিছু অংশ নিয়ে ‘খলিফাতাবাদ’ নামে একটি রাজ্য গড়ে তোলেন।
বিজ্ঞাপন
পরে ওই রাজ্য পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ আবু তাহেরকে নিয়োগ দেন। আবু তাহের হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি ছিলেন মেহেরপুরের বর্ধিষ্ণু ব্রাক্ষম গোবিন্দ ঠাকুর।
খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল বর্তমান বাগেরহাট জেলার ষাটগুম্বুজ মসজিদ। এ মসজিদ থেকেই ফলিফাতাবাদ রাজ্য পরিচালনা করা হতো। হজরত খানজাহান আলী প্রতিষ্ঠিত রাজ্যটি তিনটি পরগনায় বিভক্ত ছিল। যা যশোর, বেতকাশী ও বাগেরহাট নামে পরিচিত ছিল। এ রাজ্যের প্রশাসনিক রাজধানী বা দফরত ছিল বাগেরহাটের হাবেলী খলিফাতাবাদ পরগনায়।
ঐতিহাসিক তথ্য
জৈনপুরের সুলতান ইবরাহিম শর্কির কাছে বাংলার ইসলাম রক্ষা ও প্রচারের জন্য নুর-ই কুতুব-উল আলম নামের এক ইসলামিক ব্যক্তিত্ব ৬০ হাজার সৈন্য চান। নুর-ই কুতুব-উল আলমের কথা মতো সুলতান ইবরাহিম শর্কি ৬০ হাজার সৈন্যবাহিনী পাঠান। ওই সৈন্যবাহিনী পরিচালনায় প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’ খ্যাত হজরত খানজাহান আলী (রাহ.)।
সুলতান ইবরাহিম শর্কির অনুমতি ক্রমে হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) তার ১১ জন আধ্যাত্মিক অনুসারী ও ৬০ হাজার সৈন্যের বহর নিয়ে গনেশের রাজধানী গৌড় অতিক্রম করে বাংলায় এসে পৌছেন।
১৪১২-১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান ঝিনাইদাহর বারোবাজারে হজরত খানজাহান আলীর সৈন্যদল এসে প্রথমে ঘাঁটি গাড়েন। আধ্যাত্মিক গুরু নুর-ই-কুতুব-উল আলমের আমন্ত্রণে ধর্ম প্রচারের আসা এ কাফেলায় হজরত খানজাহানসহ যে ১১ জন ব্যক্তি এসেছিল, তারা সবাই ছিলেন জ্ঞানী ও ইলমে মারেফাতের বিশেষ বিদ্যায় পারদর্শী।
হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) ছিলেন তাদের অন্যতম। সে কারণেই তাকে এতবড় গুরু দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ঝিনাইদাহে এই ১২ জন ধর্মীয় ব্যক্তি ও যোদ্ধা অবস্থান কালীন সময়ে ওই এলাকার নাম হয় বারোবাজার।
হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) বারোবাজারে অবস্থানকালে রাজা গনেশ তার এক সুসজ্জিত প্রশিক্ষিত সৈন্যদলকে বাধা প্রদানের জন্য পাঠায়। কিন্তু তারা বারোবাজারের অদুরে বিজয়পুর নামক স্থানে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া এসব সৈন্যরা পরবতীর্তে বিভিন্ন সময় হজরত খানজাহানের ধর্ম প্রচারে বাধা সৃষ্টি করে আসছিল।
বারোবাজারে অবস্থানকালীন সময়ে খানজাহান সেখানে জনকল্যানে তিনি দিঘি খনন ও মসজিদ নির্মান করেন। পরে হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) তার এক শিষ্য রেবাস শাহ’র কাছে বারোবাজারের দায়িত্বভার ও ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পন করেন।
হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) ধর্মপ্রচারের জন্য ভৈরব নদীর উপকূল ধরে মুরালী এলাকায় অগ্রসর হন। সেখানে সৈন্যদের নিয়ে ঘাটি গাড়েন। অনুসারীদের সাথে নিয়ে দিঘি, মসজিদ নির্মান করে ওই অঞ্চলকে পর্যায়ক্রমে শহর গড়ে তোলেন।
ওই সময় বৌদ্ধদেও মুরালী নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুরালী কসবা। এই মুরালী কসবা শহরের অদুরে তিনি আরেকটি শহর গড়ে তোলেন যার নাম দেন ‘ছানি কসবা’। যা পরবর্তীকালে পুরাতন কসবা নামে পরিচিত ছিল। এই পুরাতন কসবাই বর্তমান যশোর জেলা।
তারপর হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) তার দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব গরিব শাহ ও বোরহান শাহ এর উপর ওই এলাকার দায়িত্ব ভার অর্পন করে বর্তমান মেহেরপুর পূর্বের পায়গ্রামে ঘাটি গাড়েন।
পায়গ্রাম কসবায় কিছুদিন অবস্থান করার পর তিনি মির্জাপুর ও গোপালপুরে কয়েকটি মসজিদ নির্মাণ করেন। কিছুদিন পরে তার প্রিয় শিষ্য মেহেরউদ্দীন খানকে সেখানে রেখে আবারও দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হন। মেহের উদ্দীন পীরের নাম অনুসারে পওে ওই স্থানের নাম হয় মেহেরপুর।
মেহেরপুরে ওই সময়ে অনেক হিন্দু ব্রাহ্মণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। যার মধ্যে গোবিন্দ ঠাকুর অন্যতম। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর তার খুব প্রভাব ছিল। ইসলাম ধর্ম গ্রহনের পর তার নাম রাখা হয় মোহাম্মদ আবু তাহের।
শেষ জীবন পর্যন্ত গোবিন্দ ঠাকুর বা মোহাম্মদ আবু তাহের হজরত খানজাহান আলীর (রাহ.) সহচার্যে থেকে তার প্রতিষ্ঠিত রাজ্য খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। হজরত খানজাহান আলীর (রাহ.) সমাধিস্থলের পাশেই তাকে দাফন করা হয়।
হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) রাজা গনেশের সুশিক্ষিত পলাতক সেনাবাহিনীর ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকতেন।
বর্তমান বাগেরহাট ছিল সুন্দরবনের খাদি অঞ্চলের সমতটভুমি। এখানে মগ মূর্তিপূজক, তান্তিক ও জলদস্যুরা আবাসস্থল গড়ে তুলেছিল। রাজা গনেশের পলাতক সৈন্যদল ও এই সমতটভুমিতে আবাসস্থল গড়ে তোলা তান্তিক ও জলদস্যুদের সাথে নিয়ে হজরত খানজাহান আলীর (রাহ.) সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরিকল্পনা শুরু করে।
এমনকি এ অঞ্চলের মগরাজ কর্নওয়ালি তার হস্তি বাহিনী দিয়ে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) এ সংবাদ পেয়ে সৈন্যবাহিনী নিয়ে পায়গ্রাম কসবা বা মেহেরপুর থেকে বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
মেহরপুরের পায়গ্রাম কসবা থেকে খুলনার সেনের বাজার, সামান্তসেনা, রাংদিয়া, পিলজং হয়ে অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে অনেককে পরাজিত করে বাগেরহাটের ষাটগুম্বুজ েএসে পৌছেন। এ যাত্রা পথে তার অনেক সঙ্গী শহাদাতবরণ করেন।
হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলিম হওয়া মোহাম্মদ আবু তাহেরের সাথে আনেক ব্রাহ্মণও ওই যুদ্ধে হজরত খানজাহান আলীর (রাহ.) পক্ষে অংশ নিয়ে মারা যায়।
হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) যুদ্ধে জয়ী হয়ে পরে তিনি বারাকপুরে ছাউনি ফেলে বাদোখালী বিল অতিক্রম করে সুন্দরঘোনা গ্রামে এসে উপস্থিত হন।
বারাকপুর ও সুন্দরঘোনা পাশাপাশি গ্রাম। বারাকপুরে পাকা রাস্তা ও শিবির স্থাপন করার পর সুন্দরঘোনা গ্রামে বিশাল দিঘী খনন করেন। যা ঘোড়া দিঘি নামে পরিচিত।
এই ঘোড়া দিঘীর অদুরে উত্তর দিকে হজরত খানজাহান আলীর (রাহ.) বসতভিটা। আর ঘোড়া দিঘীর পূর্ব পাড়েই তিনি তার শিবির পুনরায় স্থানাস্তর করেন তৈরী করেন ঐতিহাসিক ষাটগুম্বুজ মসজিদ। প্রতিষ্ঠা করেন খলিফাতাবাদ রাজ্য।
হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) প্রতিষ্ঠিত ষাটগুম্বুজ মসজিদ, বাসস্থান, প্রশাসনিক অঞ্চলসহ অন্যান্য স্থাপনাগুলো পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ২.৫ (আড়াই) কিলোমিটার জায়গাজুড়ে অবস্থিত।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-