আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) মেহমানদেরকে খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি ছিলেন অতিথি পরায়ণ। অতিথিদের সামনে তিনি সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকতেন। যে কোনো মেহমানকেই জানাতেন সাদর আমন্ত্রণ ও উষ্ণ অভ্যর্থনা। ধর্ম-বর্ণ ও শত্রু-মিত্রের পার্থক্য তিনি করেননি কখনোই।
অতিথিদের কাছ থেকে কোনো অসৌজন্যতা প্রকাশ পেলেও ধৈর্য ধরতেন। আদর-আপ্যায়নের যেন কোনো ত্রুটি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতেন। বিদায়বেলায় মেহমানের হাতে তুলে দিতেন উপহার-উপঢৌকন। তার আন্তরিক আতিথেয়তায় অতিথিরা মুগ্ধ-বিস্মিত হতো। সেই মুগ্ধতা অনেক মেহমানকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছে।
আতিথেয়তার ফজিলত
আতিথেয়তার ফজিলত বর্ণনা করে রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে সে যেন তার মেহমানের সমাদর করে। (মুসলিম, হাদিস : ৭৯)
সালমান ফারসি (রা.) বলেন, একবার আমি রাসূল (সা.) এর কাছে এলাম। একটি বালিশে হেলান দিয়ে তিনি বসা ছিলেন। আমাকে দেখে তিনি বালিশটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘সালমান, যখন কোনো মুসলমান তার ভাইয়ের কাছে আসে তখন তার সম্মানে যদি একটি বালিশও সে এগিয়ে দেয়, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।’ (হায়াতুস সাহাবা, পৃষ্ঠা : ৪৪৬)
সর্বজনীন আতিথেয়তা
রাসূল (সা.) এর আতিথেয়তায় শর্তের কোনো বেড়াজাল ছিল না। ধনী-দরিদ্রের তফাত ছিল না। মুসলিম-অমুসলিমের তারতম্য ছিল না। শত্রু-মিত্রের কোনো ফারাক ছিল না। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে অলিমায় শুধু ধনীদের আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং গরিবদের বাদ দেয়া হয়, তা সবচেয়ে নিকৃষ্ট খাবার।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৭৯৯)
সাহাবি রুশদ ইবনে আবদুর রহমান বলেন, ‘ইসলাম গ্রহণের আগে আমি রাসূল (সা.) এর মেহমান হয়েছিলাম। তিনি আমার খোঁজখবর নিলেন। তার কাছে আমাকে বসালেন। যতক্ষণ আমি তার কাছে ছিলাম ততক্ষণ তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। তার এই অসাধারণ আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম।’ (হায়াতুস সাহাবা, পৃষ্ঠা : ৪৪৭)
শত্রু যখন অতিথি
আরবের মুহারিব গোত্র খুবই উগ্র ছিল। কট্টর ইসলামবিরোধী ছিল। ইসলামের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে যখন মানুষ দলে দলে মদিনায় আসতে লাগল তখন মুহারিব গোত্রেরও ১০ জন লোক মদিনায় এলো। রাসূল (সা.) তাদের অভ্যর্থনা-আপ্যায়নের জন্য বেলাল (রা.) কে দায়িত্ব দেন। সকাল-বিকাল তাদের আহারের সুব্যবস্থা করেন। এতে তারা মুগ্ধ-বিস্মিত হলো এবং ইসলাম গ্রহণ করে নিজ দেশে ফিরে গেল। (আসাহহুস সিয়ার, পৃষ্ঠা : ৪৪৪)
অতিথির অসৌজন্যতায় ধৈর্য ধারণ
অতিথিদের নানা দুর্ব্যবহারে তিনি সহনশীলতার পরিচয় দিতেন। তাদের অসৌজন্যতা নীরবে সয়ে যেতেন। ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিতেন তাদের। একটু কটুবাক্যও তিনি কখনো বলতেন না। অন্যদেরও কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। এক গ্রাম্য লোক নবিজি (সা.) এর কাছে এলো। হঠাৎ সে মসজিদ-ই-নববীর ভেতরেই প্রস্রাব করতে লাগল। সাহাবায়ে কেরাম তাকে বাধা দিতে গেলে রাসূল (সা.) বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও এবং তার প্রস্রাবের ওপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। তোমরা কঠোর হওয়ার জন্য নয়, বরং নম্র ব্যবহারের জন্য প্রেরিত হয়েছ। ‘ (বুখারি, হাদিস : ২২০)
মেহমানের খাতির-যত্ন ও আপ্যায়ন
অতিথির আদর-আপ্যায়ন ও খাতির-যত্নে রাসূলের কোনো সংকোচবোধ ছিল না। তিনি মেহমানের সঙ্গে একই পাত্রে বসে খেতেন। মেহমান তৃপ্তিসহকারে খেয়ে না ওঠা পর্যন্ত তিনি উঠতেন না। বসে থাকতেন। ভালো খাবারগুলো মেহমানের দিকে এগিয়ে দিতেন। নিজের পরিবারকে অভুক্ত রেখে তিনি মেহমানদের খাওয়াতেন।
আসহাবুস সুফফা ছিলেন রাসূল (সা.) এর নিত্য মেহমান। তিনি তাদের খাতির-যত্নের কোনো কমতি রাখেননি। অন্য মেহমানদের তিনি আসহাবুস সুফফার সঙ্গে মসজিদ-ই-নববীতে থাকার ব্যবস্থা করতেন। তা ছাড়া দুই নারী সাহাবি রামলা ও উম্মে শরিক (রা.) এর ঘরেও মেহমানদের থাকার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। (শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাহ, খন্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৮০)
এতেও সংকুলান না হলে তিনি সাহাবাদের মধ্যে মেহমানদের বণ্টন করে দিতেন। তাদের খাতির-যত্নের তাগিদ দিতেন। সাহাবারাও তাদের সমাদর করতেন।
মক্কা বিজয়ের পর মদিনায় অতিথির কোনো অভাব ছিল না। রাসূল (সা.) নিজেই তাদের খেদমত আঞ্জাম দিতেন। আর সাহাবি বেলাল (রা.) কে রাষ্ট্রীয় মেহমানদের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেন। (সীরাতুন নবী, খন্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৫০৪)
বিদায়কালে উপহার দেয়া
বিদায়কালে রাসূল (সা.) মেহমানদের পথখরচ ও উপহার দিতেন। কখনো পর্যাপ্ত উপহার দিতে না পারলে অল্প হলেও দিতেন এবং মেহমানের কাছে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি কামনা করতেন। কখনো বিশেষ সাহাবিকে বলে দিতেন, যাতে তিনি তাদের পথখরচ দিয়ে দেন। অন্যান্য উপহার তো থাকতই। বিশেষত যখন কেউ তার কাছে উপহার নিয়ে আসত তখন তিনি তা গ্রহণ করতেন এবং তাকে বিদায়কালে নিজের পক্ষ থেকে অবশ্যই উপহার দিতেন। হারিস ইবনে আউফের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল রাসূলের মেহমান হলো। বিদায়কালে রাসূল (সা.) তাদের প্রত্যেককে ১০ উকিয়া পরিমাণ রুপা দিলেন। সাহাবি হারিসকে দিলেন ১২ উকিয়া পরিমাণ। (আসাহহুস সিয়ার, পৃষ্ঠা : ৪৪৩)
প্রিয় নবিজি (সা.) এর আতিথেয়তা মুসলমানদের অনুপম আদর্শ। আধুনিক যুগেও এসব সুন্নাহই আভিজাত্যের নিদর্শন। এসব সুন্নাহ থেকে মুসলমানরা নিত্য দূরে সরে যাচ্ছে। তাই আসুন, মেহমানের সমাদর করি। তাদের খাতির-যত্নে ও আদর-আপ্যায়নে সুন্নতের অনুসরণ করি। ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিই পৃথিবীময়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-