বিশেষ প্রতিবেদক •
সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের টেকনাফের নাজির পাড়া এলাকা দিয়ে এক সময় মিয়ানমার থেকে নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবার বড় চালান প্রবেশ করতো। আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানে এই এলাকা দিয়ে কিছুদিন বন্ধ ছিল ইয়াবা আসা, তবে আবারও এ পথে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে ইয়াবা কারবারিরা। বিজিবি’র পর্যবেক্ষণ, আত্মসমর্পণ করে যে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কারাগারে গিয়েছিল আলোর পথে-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়ে বেরিয়ে এসে তারাই ফের ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে।
মূলত এতদিন তারা কারাগারে থাকায় এই সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ সাময়িক বন্ধ ছিল।
মঙ্গলবার (৯ মার্চ) দুপুরে টেকনাফ বিজিবির সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান।
সোমবার (৮ মার্চ) রাত আড়াইটায় টেকনাফের নাজির পাড়ায় বেড়িবাঁধে আলুগুলা নামক এলাকায় মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে প্রবেশকালে বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত দুই মাদক পাচারকারীর বিষয়ে এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন বিজিবি।
এসময় উপস্থিত ছিলেন ২ বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর মো. রুবায়াৎ কবীর, অপারেশন অফিসার লে. মুহতাসিম শাকিল।
বিজিবি নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করতে না পারলেও স্থানীয় ইউপি সদস্য তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেন।
নিহতরা হলেন, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মৌলভী পাড়া এলাকার মো. বাবুলের ছেলে মো. ইউনুস আলম (৩৫) ও একই এলাকার মৃত আবদুল কালামের ছেলে মো. রুবেল (২০)।
সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন, নিহতরা কি ২০১৯ সালে আত্মসমর্পণ করেছিল? এর জবাবে বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, তারা বহনকারী ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রণ যারা করছে তাদের অনেকে জেল থেকে বেরিয়ে ফের এই ব্যবসায় জড়াচ্ছে। তারা বিজিবির নজরদারিতে আছে।
ইয়াবার চাহিদায় থাকায়, চালান আসা বন্ধ হচ্ছে না উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির অধিনায়ক মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান জানান, ‘মিয়ানমার সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে নাফ নদীর তীর ঘেঁষে নির্মিত হচ্ছে ৬১ কিলোমিটার লম্বা নির্মিত ‘সীমান্ত সুরক্ষা সড়ক’। এটি বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে, মাদক চালান বন্ধ হবে। তাছাড়া সীমান্তে বিজিবি কঠোরভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বলতে গেলে রুট পরিবর্তন করে মাদকের বড় চালানগুলো এখন সমুদ্র পথে পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি জেলায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মাদকের চালান আটকের ঘটনাগুলো সেটি প্রমাণ করে।
এই সীমান্তে প্রতি কিলোমিটারে একজন করে বিজিবি সদস্য দাঁড় করিয়ে দিলেও তবু অনেক পথ খালি থাকবে জানিয়ে লে. কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান বলেছেন, ‘ইয়াবার চাহিদা বন্ধ করতে ইয়াবাসেবীদের সামাজিকভাবে বয়কট-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। চাহিদা থাকলে ইয়াবা আসবে। যেহেতু এটা লাভজনক ব্যবসা, এজন্য অনেকে জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকে। মূল ইয়াবা কারবারিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে কয়েকজন রোহিঙ্গার সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির অধিনায়ক জানান, অনুপ্রবেশের ঘটনা নতুন কিছু না। গত পরশুও টেকনাফের উনচিপ্রাং সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে চার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। স্থানীয় কিছু দালালের সহযোগিতায় এপার-ওপার যাওয়া আসা করে থাকে রোহিঙ্গারা। সীমান্তে কাটাতাঁরের বেড়া নির্মাণ হলে সেটি বন্ধ হবে। তাছাড়া ইতোমধ্যে মানব পাচারকারী কিছু দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বন্দুকযুদ্ধে নিহত পাচারকারীদের বিষয়ে বিজিবির এই কর্মকর্তা জানান, ‘ওই দিনগত রাতে মিয়ানমার থেকে মাদকের একটি বড় চালান পাচারকালে নাজির পাড়া সংলগ্ন বেড়িবাঁধের আলুগুলা প্রকল্প এলাকায় অভিযানে বিজিবি ও পাচারকারীদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এসময় তিন জন মাদক পাচারকারী নৌকা থেকে লাফিয়ে সাঁতার কেটে মিয়ানমারের শূন্য রেখা অতিক্রম করে পালিয়ে যায়। পরে নৌকাটি তল্লাশি করে ৩ লাখ ৬০ হাজার পিস ইয়াবা, একটি দেশীয় তৈরি বন্দুক ও একটি কিরিচসহ গুলিবিদ্ধ দুই জনকে উদ্ধার করে টেকনাফ সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে, কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ লাশ মর্গে পাঠিয়েছে। এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শুভ দেব বলেন, ‘গভীর রাতে বিজিবি দু’জন গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে নিয়ে আসেন। তাদের শরীরে তিনটি করে গুলির আঘাত রয়েছে। এখানে আনার আগে তারা মারা যান। এসময় আহত দুজন বিজিবির সদস্যকেও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. এনামুল হক জানান, ‘‘মাদক পাচার করতে গিয়ে বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তার এলাকার দুই জন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। তারা মাদক কারবারি না পাচারকারী। কিন্তু প্রকৃত ইয়াবার মালিক হচ্ছে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাদেরকে আইনের আওতায় না আনলে মাদক পাচার বন্ধ হবে না।’
এদিকে গত শুক্রবার টেকনাফ উপজেলায় পৃথক অভিযান চালিয়ে প্র্রায় চার লাখ ইয়াবাসহ তিন জনকে আটক করেছে। এসব ইয়াবার মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের হাতে সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা ও ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। এসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ মহা-পরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এরপর গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দফায় আরও ২১ ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পণ করেন। তবে আদালতে নানা ছুঁতো দেখিয়ে এরইমধ্যে সবাই জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-