জাগো নিউজ ডেস্ক •
ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সিলেটের উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. ইমরান খান রুমেল। এই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তার স্ত্রী ডা. শারমিন আক্তার অন্তরা। কিন্তু এই চিকিৎসক দম্পতির ছোট্ট দুটি শিশুকন্যা এখনো বুঝে উঠেতে পারেনি তাদের বাবা এই পৃথিবীতে আর নেই।
দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ স্বজনরা যখন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কান্নাকাটি করছিলেন শিশু দুটি তখনো বিস্কুট খাচ্ছিল আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। তখন এই চিকিৎসক দম্পতির সাড়ে চার বছর বয়সী বড় মেয়ে এনায়া খান নানিকে বলছিল, ‘কেঁদো না নানু, বাবা-মা চলে আসবে নে।’
আর ছোট মেয়ে তিন বছর বয়সী এন্তেসার খান নানির কোল থেকে ফ্যাল ফ্যাল করে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল। তারা এখনো বোঝেনি তাদের বাবা আর কোনো দিন তাদেরকে আদর করে কোলে তুলে নেবেন না।
ডা. ইমরানের বাবা (অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. আমজাদ হোসেন খান সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান ছিলেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে তার। দুজনই চিকিৎসক। ছেলের বউ আর মেয়ে জামাইও চিকিৎসক। একেবারে সুখের সংসার যাকে বলে।
নাতি-নাতনি নিয়ে আনন্দেই সময় কাটছিল আমজাদ হোসেন দম্পতির। এই সুখের সংসারে শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) আচমকা অন্ধকার নেমে আসে।
ডা. ইমরানের স্ত্রী ডা. অন্তরার স্বপ্ন ছিল সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক হয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করবেন। তিনি ৪২তম বিসিএস (স্বাস্থ্য) পরীক্ষার্থী ছিলেন। চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সময় নির্ধারিত ছিল শুক্রবার বেলা তিনটায়। তাই শুক্রবার ভোরেই স্ত্রীকে নিয়ে বাসা থেকে বের হন ডা. ইমরান। এনা পরিবহনের একটি বাসে করে সিলেট থেকে ঢাকার পথে রওয়ানা দেন তিনি।
তবে ঢাকা আর যাওয়া হয়নি তাদের। সিলেট শহর থেকে বেরিয়ে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার রশিদপুরে আসা মাত্রই দুর্ঘটনার শিকার হয় তাদের বহনকারী বাসটি। বিপরীত দিক থেকে আসা লন্ডন এক্সপ্রেসের একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় তাদের বাসের। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ডা. ইমরান। গুরুতর আহত হন ইমরানের স্ত্রী অন্তরা। এ দুর্ঘটনায় আরও ছয়জন নিহত ও ১৮ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনায় ছেলের মৃত্যুর খবর সকালেই পৌঁছে যায় ডা. আমজাদ হোসেন খানের কাছে। খবর পেয়েই পড়িমড়ি করে তিনি ছুটে আসেন ওসমানী হাসপাতালে। যে হাসপাতালে দীর্ঘকাল কাজ করে গেছেন ডা. আমজাদ সেখানেই পড়ে আছে নিজের ছেলের নিথর দেহ। নিজেকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না তিনি। হাসপাতালের মর্গের সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ডা. আমজাদ।
ইমরান খানের মা ফরিদা খান হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ছেলের লাশ দেখে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন। এ সময় ইমরানের বোন উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ইন্নরি খানও কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ছেলেমেয়ে নিয়ে নগরের ফাজিল চিশতী এলাকায় থাকেন ডা. আমজাদ। শুক্রবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায় আরও হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় ডা. ইমরানের মা। কোনো কথাই বলতে পারছেন না। কেবল হা-হুতাশ করে চলছেন। পরিবারের সবারই একই অবস্থা।
ইমরান-অন্তরা দম্পতির দুই মেয়ে। একজনের বয়স সাড়ে চার বছর। অপরজনের তিন বছর। ঢাকায় যাওয়ার আগে বাবা-মা তাদের নানা বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন।
ডা. অন্তরার বাবা আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, মেয়েটা উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করার পর থেকে বিসিএসের জন্য লেখাপড়া শুরু করে। তার বড় একটি স্বপ্ন ছিল সরকারি হাসপাতালে চাকরি করে গরিব মানুষের সেবা করবে। সেই জন্য আজ মেয়ে জামাই মেয়েটাকে ঢাকায় বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার জন্য নিয়ে রওয়া হয়। এর ঘণ্টা দুই পরেই খবর এলো, তারা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মেয়ে জামাই হলেও ইমরান আমার নিজের ছেলের মতো। ছেলেটা খুবই ভদ্র ছিল। এখনো মেয়েটাকে জানাইনি, তার স্বামী আর নেই। যখন জানবে তখন কী দিয়ে আমি তাকে সান্ত্বনা দেব, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আবু বক্কর।
ইমরানদের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এক নারী বলেন, সকালে ইমরানের বোন ডা. ইন্নরির চিৎকারে আমাদের ঘুম ভাঙে। সে আমাদের ডেকে এই দুর্ঘটনার খবর জানায়।
তিনি বলেন, আমজাদ সাহেবের পরিবার খুবই মেধাবী এবং অত্যন্ত ভদ্র। দীর্ঘদিন ধরে আমরা প্রতিবেশী হিসেবে আছি। কিন্তু এই পরিবারের কেউ জোরে কথা বলেছে এমনটি শুনিনি। ইমরানও খুব নম্র- ভদ্র ছেলে। এরকম মানুষ হয় না।
ইমরানদের বাসায় গিয়ে কথা হয় তাদের আত্মীয় সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুমিনুল হকের সঙ্গে। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দন্ত বিভাগের চিকিৎসক মুমিনুল বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই দুর্ঘটনার খবর পেয়েছি। কিন্তু এই দুর্ঘটনায় যে আমার পরিচিতজনেরাও হতাহত হয়েছেন তা বুঝতে পারিনি। পরে ইমরানের কথা শুনলাম।
তিনি বলেন, এত ভালো একটা পরিবার। তাদের ক্ষেত্রেই এমন দুর্যোগ নেমে এলো। এখন আমজাদ স্যারকে আমরা কী বলে সান্ত্বনা দেবো?
ডা. মুমিনুল বলেন, ইমরানের স্ত্রী ডা. অন্তরাও গুরুতর আহত হয়েছেন। এখন আমাদের চাওয়া বাচ্চা দুটোর জন্য হলেও অন্তরা যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার সকাল সাতটার দিকে সিলেটগামী লন্ডন এক্সপ্রেস ও ঢাকাগামী এনা পরিবহনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ছয়জন মারা যান। এছাড়া হাসপাতালে মারা যান আরও একজন। এই দুর্ঘটনায় অন্তত ১৮ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
নিহতরা হলেন-সিলেটের উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক আল মাহমুদ সাদ ইমরান খান (৩৩), এনা পরিবহনের বাসের চালক ওসমানীনগর উপজেলার ধরখা গ্রামের মঞ্জুর আলী (৩৮), এনার সুপারভাইজার সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মিঠাভরা গ্রামের সালমান খান (২৫), হেলপার ধরখা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন (২৪), লন্ডন এক্সপ্রেসের চালক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার রাজানিয়াকান্দি পশ্চিম পাড়ার রুহুল আমিন (৫০), ঢাকার ওয়ারি এলাকার বাসিন্দা কলেজছাত্র নাদিম আহমদ সাগর (১৯), সিলেট নগরের আখালিয়া নায়াবাজার এলাকা শাহ কামাল (৪৫) ও ছাতক উপজেলার বাউয়ালী গ্রামের মফিজ আলীর মেয়ে রহিমা খাতুন (৩০)।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-