হুমকিতে জীববৈচিত্র্য, বিজ্ঞপ্তিতে ‘সীমাবদ্ধ’ বিধিনিষেধ

জাগো নিউজ ডেস্ক •

পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত এবং অসাবধানতা ও অসচেতনতার ফলে হুমকির মুখে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে পরিবেশ অধিদফতর। তবে সেই বিধিনিষেধ যেন গণবিজ্ঞপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবায়নে বাস্তবিক কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি সেন্টমার্টিন গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসছেন। কেউ কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এমনকি পরিবেশ অধিদফতর যেসব ক্ষেত্রে বিধিনিষিধ আরোপ করেছে তাও আমলে নিচ্ছে না কেউ। যেখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, সেন্টমার্টিনের কোথাও কোথাও ময়লার ভাগাড় তৈরি হয়েছে। সৈকতে সামুদ্রিক প্রাণী মরে পড়ে আছে। সেন্টমার্টিনের বর্তমান পরিবেশ দেখে আগে ভ্রমণ করা অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেন।

সেন্টমার্টিনে অনিয়ন্ত্রিত ভ্রমণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে পরিবেশ অধিদফতরের গণবিজ্ঞপ্তিতেও। দ্বীপটিকে ‘প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন’ এলাকা ঘোষণা করে এ সংক্রান্ত গণবিজ্ঞপ্তিতে পরিবেশ অধিদফতর বলেছে, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন এবং পর্যটকদের অসচেতনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, পরিবেশ এবং প্রতিবেশবিরোধী আচরণের কারণে সেন্টমার্টিনের বিরল প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

পরিবেশ ও বিরল জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারসহ দ্বীপটিকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এর ০৪ ধারার ক্ষমতাবলে সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা গণবিজ্ঞপ্তিতে ‘বিধি-নিষেধের লঙ্ঘন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ’ বলে উল্লেখ করা হয়।

সরকারের পক্ষ থেকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে স্পিডবোট, কান্ট্রি বোট, ট্রলার কিংবা অন্যান্য জলযানে যাতায়াত কিংবা নোঙর করা যাবে না। এমনকি ছেঁড়াদিয়া বা ছেঁড়া দ্বীপ ভ্রমণ করা যাবে না বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দ্বীপের সৈকতে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যানসহ কোনো ধরনের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক বাহন চালানো যাবে না বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

অথচ প্রতিদিন শত শত মানুষ স্পিডবোট, কান্ট্রি বোটে চেপে অবাধে ছেঁড়া দ্বীপে যাচ্ছেন। এমনকি সমুদ্র সৈকত দিয়ে মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলে চালিয়েও ছেঁড়া দ্বীপে যাচ্ছেন অনেকে। শত শত বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেলের চাকা ছেঁড়া দ্বীপের বুক পিষ্ট করার পাশাপাশি দ্বীপটির বিরল প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস করছে।

সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ক্ষেত্রে সরকারের দেয়া বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (প্লানিং) মো. সোলায়মান হায়দার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছেঁড়া দ্বীপে মানুষ মোটরসাইকেল, বাইসাইকেলে যায়, সবকিছুই আছে। এখন কি আপনি একদিনে বাঙালিকে মানুষ করে ফেলতে পারবেন? এটা কি সম্ভব? সব আইন কি একদিনে কার্যকর হয়ে যায়? এটা (গণবিজ্ঞপ্তি) দেয়া হয়েছে এ বছর যতটা সম্ভব কার্যকর হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন (৩১ জানুয়ারি) আমি সেন্টমার্টিনে। আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। আরও কত ইফেক্টিভ (ফলপ্রসূ) করা যায়, তার জন্য সব প্রক্রিয়া চলছে। সরকার উচ্চ পর্যায় থেকে কাজ করছে। কোনো অন্যায় অপরাধ একদিনে বন্ধ করা যায় না, অনেক সময় লাগে। আপনারা সচেতনতা তৈরি করে যান।’

সেন্টমার্টিন বাজার থেকে বাইসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছেঁড়া দ্বীপে আসা নিয়াজুর রহমান বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে সুন্দর স্থান ছেঁড়া দ্বীপ। ছেঁড়া দ্বীপ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এমন তথ্য অনলাইনে দেখেছি। তবে সেন্টমার্টিন এসে জানতে পেরেছি, এখনো সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়নি। যে কেউ ইচ্ছা করলেই ছেঁড়া দ্বীপে যেতে পারছেন। তাই আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে সাইকেল ভাড়া করে ছেঁড়া দ্বীপে এসেছি। পথে কেউ কোনো বাধা দেয়নি, নিষেধও করেনি। শুধু আমরা না, আমাদের মতো অনেকে সাইকেল নিয়ে এসেছেন।’

jagonews24

দ্বীপের সৈকত, সমুদ্র ও নাফ নদীতে প্লাস্টিক বা কোনো ধরনের বর্জ্য ফেলা যাবে না বলে পরিবেশ অধিদফতরের গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভ্রমণকারীরা যেখানে সেখানে ছুড়ে ফেলছেন বর্জ্য পদার্থ। এমনকি গণবিজ্ঞপ্তির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পশ্চিম দিকের সৈকতে কোনাপাড়ার পর দক্ষিণ দিকে এবং পূর্ব দিকের সৈকতে গলাচিপার পর দক্ষিণ দিকে অবাধে যাচ্ছেন ভ্রমণকারীরা।

জোয়ার-ভাটা এলাকায় পাথরের ওপরও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অসংখ্য ভ্রমণকারী। অথচ গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জোয়ার-ভাটা এলাকায় পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটা যাবে না। সৈকতে মাইক বাজানো, হইচই এবং উচ্চস্বরে গান-বাজনা কিংবা বারবিকিউ পার্টি করা যাবে না— এমন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কেউ তা মানছে না। জাহাজ থেকে পাখিকে চিপস বা অন্য কোনো খাবার খাওয়ানো যাবে না— এ নিষেধাজ্ঞাও ‘থোড়াই কেয়ার’ করছেন ভ্রমণকারীরা।

পরিবার নিয়ে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করতে আসা রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডার বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কয়েক বছর আগে সেন্টমার্টিন এসেছিলাম। তখন সেন্টমার্টিন খুব সুন্দর ছিল। এখন তার কিছুই নেই। অনেকটা ঢাকার বস্তির মতো হয়ে গেছে। সেন্টমার্টিনের এমন চিত্র দেখে খুব খারাপ লাগছে। সেন্টমার্টিন রক্ষায় যথাযথ উদ্যোগ না নেয়ায় আজ এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’

প্রথমবার সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসা কুমিল্লার বাসিন্দা হুমায়ন রশীদ বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। সে কারণে অনেক টাকা খরচ করে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে তো মনে হচ্ছে টাকাই পানিতে গেল! সমুদ্রের পানি ছাড়া তো এখানে কিছুই দেখা যায় না।’

আব্দুল্লাহ নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘এক সময় আমাদের এখানে খুব বেশি স্থাপনা ছিল না। কিন্তু মানুষ ভ্রমণ করায় দিন দিন স্থাপনা বাড়ছে। গড়ে উঠেছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল। এ কারণে পূর্বদিকের সৌন্দর্য কিছুটা নষ্ট হয়েছে। তবে পশ্চিম পাশ ও ছেঁড়া দ্বীপের সৌন্দর্য এখনো আছে।’

সেন্টমার্টিনের আবাসিক হোটেলের ব্যবসা করা দেলোয়ার নামের একজন বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের মূল সৌন্দর্য ছেঁড়া দ্বীপ এবং পশ্চিম পাড়। কিন্তু যারা একদিনের জন্য সেন্টমার্টিন আসেন তারা জাহাজ থেকে নেমে জেটি ঘাটের আশপাশ ঘুরে চলে যান। যে কারণে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, সেন্টমার্টিনে কিছুই নেই। আসলে সেন্টমার্টিনের প্রকৃত সৌন্দর্য দেখতে হলে এখানে এসে থাকতে হবে এবং সময় ভাগ করে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে হবে। তাহলেই সেন্টমার্টিনের প্রকৃত সৌন্দর্য ধরা পড়বে।’