মার্কিন হুঁশিয়ারি এসেছে, দ্রুত মুক্ত করা হোক নেত্রী সু কি কে। বিশ্ব জুড়ে প্রতিক্রিয়া সেনা অভ্যুত্থানের। এর মাঝে প্রায় নীরবেই বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করল মায়ানমার।
সোমবার সকালে রক্তপাতহীন সেনা অভ্যুত্থানে ফের গৃহবন্দি হয়েছেন মায়ানমারের সর্বময় শাসক আউং সান সু কি। প্রেসিডেন্ট সহ মন্ত্রিসভার সবাইকে বন্দি করেছে বর্মী সেনা। সেনা শাসনের ঘেরাটোপে মায়ানমার।
বিবিসি জানাচ্ছে, নোবেল জয়ী সু কি বন্দি হয়েছেন খবরে আন্তর্জাতিক মহল তীব্র সরগরম। এর মাঝে নীরবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে মায়ানমার। সেনা বাহিনির প্রধান মিন অং লাইংয়ের এখন ক্ষমতায়। তাঁর নির্দেশে রাজধানী ইয়াঙ্গন বিচ্ছিন্ন গোটা দেশ থেকেই। বন্ধ করা হয়েছে ইয়াঙ্গন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। তবে কিছু এলাকায় ইন্টারনেট ও ফোন সংযোগ চালু রেখেছে সেনা বাহিনি। আশঙ্কা এর পর নির্দিষ্ট কিছু সংযোগ ছাড়া পুরো মায়ানমারে ইন্টারনেট ও ফোন পরিষেবা বন্ধ করা হবে।
রাজধানী ইয়াঙ্গন থেকে আসা যাওয়া বন্ধ করেছে সেনা। রাস্তায় রাস্তায় নেমেছে অতিরিক্ত সেনা। চলছে টহলদারি। বিবিসি জানাচ্ছে,ইয়াঙ্গনের বাসিন্দারা এরই মধ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন। খাবার মজুতের জন শুরু হয়েছে মরিয়া চেষ্টা। অনেকেই বা শুকনো খাবার কিনতে শুরু করেছেন।নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ যে কোনও সময় বন্ধ হতে পারে।
বিবিসি জানাচ্ছে, সেনা বাহিনি ইতিমধ্যে সব সরকারি দফতরের দখল নিয়েছে। সেনা কর্তারা ছাড়া বাকি কোনও অসামরিক কর্মকর্তাদের প্রবেশে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। রক্তপাতহীন এই সামরিক অভ্যুত্থানের জেরে মায়ানমার আবার বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে। ভারতের প্রতিবেশি দেশটির নেত্রী সু কি আগেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহবন্দি ছিলেন।
১৯৮৯-২০১০ তিনি বন্দি থাকা অবস্থায় বিশ্ব জুড়ে তৈরি হয়েছিল জনমত। প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মুক্তি পান নয়াদিল্লির লেডি শ্রী রাম কলেজের প্রাক্তনী। বিবিসি জানাচ্ছে, সেনা ঘেরাটোপে থেকেও হুঙ্কার ছেড়েছেন নেত্রী সুম কি।
তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ( এনএলডি) পার্টি সোমবার জানিয়েছে নেত্রী জনগণকে এই সেনা অভ্যুত্থান মেনে না নিয়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, “সামরিক বাহিনির এই পদক্ষেপ দেশকে আবার স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেয়ার পদক্ষেপ।”
এদিকে সেনাবাহিনি জানায়,দেশে এক বছরের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সু কি অন্য নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে গত নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ করেছে সেনা।
যে কারণে সু চিকে সরিয়ে ক্ষমতা নিলো সেনাবাহিনী
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানে নির্বাচিত সরকারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখলের পর এখন সর্বত্র একটিই আলোচনা চলছে, কেন সু চিকে সরিয়ে সেনাবাহিনী নিজেই ক্ষমতা দখল করল? যেখানে সু চি সম্পর্কে বলা হচ্ছিল, সেনাবাহিনী সু চির নীতি গ্রহণ করেনি, সু চিই সেনাবাহিনীর নীতি গ্রহণ করে ক্ষমতায় আছে।
এরকম একটি অবস্থায় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল করার কয়েকটি কারণ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইয়াঙ্গুনে দীর্ঘ এক দশক ধরে বসবাসরত বাংলাদেশি ও একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান আজ সোমবার দুপুরে বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
প্রথমত, একটি রাজনৈতিক সরকার যদি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে তবে সামরিক বাহিনীর গুরুত্ব কমে যেতে পারে। এরকম ধারণা করে থাকতে পারে সেনাবাহিনী।
দ্বিতীয়ত, এতে জনগণের মনে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে যে, এখন আর সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ নয়, রাজনীতিবিদরাই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে মিয়ানমারের সমাজ জীবনে সেনাবাহিনী তার গুরুত্ব হারাবে। এখনকার সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াংয়ের অবসরের সময় হয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মামলা চলছে।
অবসরে গেলে সু চির সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে তার পক্ষে অবস্থান নাও নিতে পারে। এমন একটি আশংকা সম্ভবত তার ভেতরে তৈরি হয়েছে। সেনাবাহিনী ক্ষমতায় থাকলে আন্তর্জাতিক আদালতে তিনি সব রকমের সহায়তা পাবেন।
তৃতীয়ত, সেনাপ্রধান মিন অং অবসরের পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ক্ষমতায় আসতে চান বা প্রেসিডেন্ট হতে চান। সু চির রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে সেটা হওয়া কঠিন। গত নির্বাচনে সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দলটির ফলাফল অত্যন্ত শোচনীয় হয়েছে।
নির্বাচনে ৪১২টি আসনের মধ্যে ৩৪৬টি আসন পেয়েছে সু চির এনএলডি ও সেনা সমর্থিত ইউএসডিপি ৩৩টি আসন। ফলে অবসরের পর সু চির রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তিনি পারবেন না। সে কারণেই রাজনৈতিক সরকারের পরিবর্তে সামরিক সরকারকে ক্ষমতায় রেখে তিনি অবসরে যেতে চাইছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আজ সোমবার সকালে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই রাজধানীতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। রাস্তায় সেনা বা পুলিশের টহল নজরে পড়ছে না। রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি একেবারেই কম।
দেশটিতে ইন্টারনেটের গতি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে এসেছে। বেসরকারি মোবাইল অপারেটর সেবা বন্ধ থাকলেও চালু হয়েছে সরকারি মোবাইল অপারেটর সেবা।
মিয়ানমারের জনগণের এখন কী করণীয়, সে সম্পর্কে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী একজন বাংলাদেশি মিয়ানমার থেকে বলেন, তিনি সু চির দলের একজন নেতার ব্যাপারে খোঁজ নিতে তার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু সেই নেতার ছেলে জানান যে, তার বাবাসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে তিনি কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না। ধারণা করা হচ্ছে, সেনাবাহিনী তাদের আটক করেছে।
বাংলাদেশি ওই নাগরিক আরও জানান, মিয়ানমার সরকারের আদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করা হয়নি। ইন্টারনেটের ধীরগতির কারণে অধিকাংশ ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চি দেশটির জনগণের প্রতি যেকোনো অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন। আজ সোমবার সেনাবাহিনীর হাতে আটক হওয়ার আগে তিনি এ আহ্বান জানান বলে দাবি করেছে তার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)।
অপরদিকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা। ২৭ জাতির জোটটির নেতারা অবিলম্বে দেশটিতে আটক রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির দাবি করেছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
মিয়ানমার: ১৯৪৮ থেকে ২০২১
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ৫০ বছরের বেশি সময় থেকেছে সেনা শাসনের অধীনে।
আজ সোমবার আবারও মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে।
২০২০ সালের ৮ নভেম্বর দেশটিতে পার্লামেন্টারি নির্বাচনে অং সান সু চির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৪১২ আসনের মধ্যে ৩৪৬টিতে জয় পায়। আজ পার্লামেন্টে নির্বাচিত সরকারের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। অধিবেশনের প্রাক্কালে আজ ভোরে গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে সেনাবাহিনী।
সেই নির্বাচনে সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি জিতেছিল ৩৩টি আসন।
সেনা-নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম মিয়াওয়াদ্দি নিউজ’র বরাত দিয়ে মিয়ানমার টাইমস জানিয়েছে, প্রতিরক্ষা বিভাগের কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লাইয়াং জরুরি অবস্থা চলাকালে মিয়ানমারের সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
মিয়ানমারে ‘ভঙ্গুর গণতন্ত্র’ নিয়ে আলোচনার আগে দেশটির ইতিহাস সংক্ষেপে জেনে নেওয়ায় যেতে পারে।
১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ উপনিবেশ মিয়ানমারে (তৎকালীন বার্মা) অভিযান চালায় জাপান। জাপানে প্রশিক্ষিত বার্মা ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মির সহায়তায় দেশটি দখল করে নেয় তারা। বার্মা ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি পরবর্তীতে অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লীগে (এএফপিএফএল) রূপান্তরিত হয় এবং মিয়ানমারে জাপানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
১৯৪৫ সালে অং সানের নেতৃত্বাধীন এএফপিএফএল’র সহায়তায় জাপানি দখলদারিত্ব থেকে মিয়ানমারকে মুক্ত করে ব্রিটেন।
এর দুই বছর পর মিয়ানমারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অং সান ও ছয় সদস্যকে হত্যা করে অং সানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী উ স’র নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা।
জাপানি দখলদারিত্বের সময় মিয়ানমারের বা মও সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ নু’কে এএফপিএফএল ও দেশটির সরকার প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৪৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উ নু ক্ষমতায় থাকাকালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৫৮ সালে ক্ষমতাসীন এএফপিএফএল-এ ভাঙন দেখা দিলে চিফ অব স্টাফ জেনারেল নে উইন এএফপিএফএল সরকারকে সরিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন।
১৯৬০ সালের নির্বাচনে এএফপিএফএল’র উ নু’র নেতৃত্বাধীন অংশ জয়ী হলে তার রাজনৈতিক নীতিমালা সেনাবাহিনীকে ক্ষুব্ধ করে।
১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উ নু’র সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। সেসময় তিনি মিয়ানমারের ফেডারেল ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে ‘নিজস্ব ঘরানার সমাজতন্ত্র’ চালু করেন। পাশাপাশি তিনি অর্থনীতিকে জাতীয়করণ ও সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি নামে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। জেনারেল উইন দেশটিতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমও নিষিদ্ধ করেন।
১৯৭৪ সালে দেশটিতে নতুন সংবিধান চালু হয়। সশস্ত্র বাহিনীর হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জেনারেল নে উইন ও অন্যান্য সাবেক সামরিক নেতাদের পরিচালিত পিপলস অ্যাসেম্বলির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
১৯৮১ সালে জেনারেল নে উইন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সান ইউয়ের কাছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তবে তিনি সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
১৯৮৭ সালে মিয়ানমারে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হলে দেশটির জনগণ সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। সেসময় সামরিক সরকারের হাতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী নিহত হন। ১৯৮৮ সালে সরকার দ্য স্টেট ল অ্যান্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিল (এসএলওআরসি) গঠন করে।
১৯৮৯ সালে মিয়ানমারে সামরিক আইন জারি করা হয়। সেসময় বার্মার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমার রাখার পাশাপাশি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারপন্থি কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সানের মেয়ে ও এনএলডি নেতা অং সান সু চিকে গৃহবন্দি করা হয়।
১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতনের পর মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। বিরোধী এনএলডি নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হলে সেনাবাহিনী সে ফল উপেক্ষা করে।
মিয়ানমারে শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালানোয় ১৯৯১ সালে সু চিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
১৯৯২ সালে সামরিক বাহিনীর থান সুয়ে এসএলওআরসি’র চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে জেনারেল স মাউংকে ক্ষমতায় বসান।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ও দীর্ঘদিন পশ্চিমের দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা মিয়ানমার সরকার ১৯৯৫ সালে অং সান সু চিকে ছয় বছর গৃহবন্দি রাখার পর মুক্তি দেয়। এর পরের বছর সু চি তার দলের প্রথম কংগ্রেসে যোগ দিলে সামরিক সরকার ২০০ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে।
২০০০ সালে মিয়ানমারের ওপর ইউরোপ অবরোধ কঠোর করলে সামরিক জান্তা সু চিকে আবারও আটক করে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এর দুই বছর পর তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার। সেসময় সু চির দেশের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়।
সু চির গাড়িবহরে হামলার পর নিরাপত্তার কথা বলে তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয় ২০০৩ সালে। বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে’র তথ্য মতে, সে বছরের মে মাসে সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক মিলিশিয়া ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (ইউএসডিএ) সমর্থকদের হামলায় সু চির ৭০ জনের বেশি সমর্থক নিহত হন।
ইউএসডিএ পরবর্তীতে ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) নাম ধারণ করে। এই দলটিই সেনাবাহিনীর দল হিসেবে পরিচিত।
সামরিক সরকার জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি তুলে নিলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ হয় ২০০৭ সালে। সেসময় সামরিক অভিযানে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হন।
২০০৮ সালে মিয়ানমারে সামুদ্রিক ঝড় নার্গিস আঘাত হানলে এর দুই দিন পর দেশটিতে গণভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে আলোচনার পরিকল্পনা করলে পরের মাসে সু চি সামরিক জান্তার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। সেসময় তাকে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা করারও অনুমতি দেয় সরকার।
সামরিক সরকার ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এনএলডি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট তিন উ’কে এক দশকের বেশি সময় কারাবন্দির পর মুক্তি দেয়। সে বছরের মার্চে সরকার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন আইন পাশ করে। এনএলডি’র একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে মত দেয়।
দীর্ঘ ২০ বছর পর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি বিজয় দাবি করে। বিরোধীরা সেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে।
সরকার নির্বাচনটিকে সামরিক শাসন থেকে বেসামরিক শাসনে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করে।
নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর সামরিক জান্তা সু চিকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেয়।
২০১১ সালের মার্চে থিয়েন সেইন দেশটির নতুন ও বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। সে বছরের আগস্টে তিনি সু চির সঙ্গে দেখা করেন। অক্টোবরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে মুক্তি দেওয়া হয়।
নভেম্বরে সু চি ঘোষণা দেন তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী।
২০১২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টের উপ-নির্বাচনে সু চিসহ এনএলডির প্রার্থীরা জয় লাভ করেন। সেসময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বছরের জন্য মিয়ানমারের ওপর থেকে সব বেসামরিক অবরোধ তুলে নেয়।
২০১৩ সালের এপ্রিলে পাঁচটি বেসরকারি দৈনিক পত্রিকার অনুমতি দেয় মিয়ানমার সরকার। প্রায় ৫০ বছর পর দেশটিতে বেসরকারি পত্রিকা অনুমতি পায়।
২০১৪ সালের অক্টোবরে সরকার ঘোষণা দেয় যে, ২০১৫ সালের শেষের দিকে মিয়ানমারে পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেসময় সরকার ৩ হাজার বন্দিকে মুক্তি দেওয়ারও ঘোষণা দেয়।
২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে সু চির নেতৃত্বাধীন বিরোধী এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয় পায়।
২০১৬ সালের মার্চে হতিন কিয়াও প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলে দেশটিতে নতুন যুগের সূচনা হয়। প্রায় ৫০ বছরের সেনা আধিপত্যের পর সু চির গণতান্ত্রিক আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রভাব ফেলে।
প্রথম মুক্ত নির্বাচনের চার বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে আবার পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে ৪১২ আসনের মধ্যে ৩৪৬টিতে বিজয়ী হয় ক্ষমতাসীন এনএলডি এবং সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি জিতেছিল ৩৩ আসন।
নির্বাচনে ভরাডুবির পর দেশটির সামরিক বাহিনী ‘কারচুপি’র অভিযোগ তোলে। সেসময় থেকে সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। তখন থেকে সেনা অভ্যুত্থানের গুঞ্জন ওঠে। অবশেষে সেই গুঞ্জন বাস্তবে পরিণত হয় আজ।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-