সমকাল •
হামিদা বেগম রিনা বসবাস করেন আশুলিয়ার ইয়ারপুরের পশ্চিমপাড়ায়। সম্প্রতি হামিদার বড় বোন মিনারা বেগম তাদের চার বোনের নামে পাঁচ শতাংশ জমি নিবন্ধন করে দেন। তবে ওই জায়গাটি আগে থেকে ভোগদখল করে আসছিলেন তাদের ভাই নেছার আহমেদ। ওই জায়গায় চার বোন মিলে বাড়ি করতে গেলে বাধা দেন নেছার। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় জিডি করেন হামিদা। জিডি করার সময় হামিদার কোনো অর্থ খরচ হয়নি।
জিডির তদন্ত করতে গিয়ে সাক্ষীদের বক্তব্য নেন আশুলিয়া থানার এসআই জয়ন্ত মজুমদার। এ সময় ‘খুশি’ হয়ে জোর করে তাকে দেড় হাজার টাকা দিয়েছেন হামিদা। তা সত্ত্বেও তদন্ত এগোয়নি। বাধ্য হয়ে হামিদা আবার থানায় যান। তখন এসআই জয়ন্ত ঘটনার তদন্তের জন্য এসআই জুয়েল রানাকে পাঠান। তিনি হামিদার ভাই নেছারের বক্তব্য নেন। ওই দিনও জিডির বাদী হামিদা এসআই জুয়েল রানাকে ‘খুশি হয়ে তার গাড়ির তেল খরচ বাবদ’ ৫০০ টাকা দেন। এর পরও ভাইয়ের অত্যাচার থেকে মুক্তি মেলেনি হামিদার। বাধ্য হয়ে আবার থানায় যান হামিদা। তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় এসআই সঞ্জিতের। তার পরামর্শে আবারও জিডি করেন তিনি। সঞ্জিত কোনো টাকা ছাড়াই হামিদাকে আইনি সহায়তা করেন। তাকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আইনি প্রতিকার চেয়ে জিডি বা মামলা করতে যারা থানায় যান সেসব ভুক্তভোগী অনেক সময় ‘খুশি’ হয়ে পুলিশকে ঘুষ দেন। এবার ‘খুশির ঘুষ’ গ্রহীতা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ। এ জন্য একটি চৌকস টিম গঠন করা হয়েছে, যারা জিডি ও মামলার বাদীর সঙ্গে কথা বলে অনৈতিক লেনদেনের তথ্য যাচাই করছেন। এ ছাড়া ঘুষ গ্রহীতা শনাক্তে অডিও রেকর্ড শুনছেন তারা।
এ প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে শতাধিক পুলিশ সদস্য শনাক্ত হয়েছেন, যারা জিডি ও মামলার বাদীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। ঢাকা রেঞ্জের ১৩টি জেলায় এই কার্যক্রম শুরুর পর মাঠপর্যায়ের অসাধু পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে কোনো অভিযোগ পেলে সাক্ষীর বক্তব্য গ্রহণ ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তদন্ত করা হয়। এর পর অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
জানা গেছে, এরই মধ্যে আশুলিয়া থানার এসআই জয়ন্ত ও জুয়েলের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে টাকা নেওয়ার বিষয় প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে তারা দু’জন যা করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়।’
একই রকমের ঘটনা ঘটেছে ধামরাইয়ের কুল্ল্যার কেলিয়া গ্রামের মনোরঞ্জন সরকারের ক্ষেত্রেও। আদুরী সন্ন্যাসী নামে তার এক পিসির (ফুফু) সঙ্গে জমি নিয়ে ঝামেলা তার দেবরের। এ ঘটনায় আদুরীর বিরুদ্ধে জিডি করেন দেবর। এ ঘটনা তদন্ত করতে ঘটনাস্থলে যান ধামরাই থানার এসআই মোখলেছুর রহমান। এ ঘটনায় বাদী-বিবাদী কী ধরনের পুলিশি সেবা পেয়েছেন তার খোঁজ নিতে গিয়ে অডিও রেকর্ড পর্যালোচনা হয়। এতে দেখা যায়, মনোরঞ্জনের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন এসআই মোখলেছুর। তবে পুলিশের তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদে মনোরঞ্জন অর্থ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তবে মনোরঞ্জন স্বীকার করেন, আদুরীর কাছ থেকে ঘুষের কথা বলে দুই দফায় তিন হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি। পরে এই টাকা নিজেই খরচ করে ফেলেন।
শুধু জিডি-মামলা নয়, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন করতে গিয়েও পুলিশের কোনো সদস্য সেবা গ্রহীতার কাছ থেকে অর্থ নিলে তা শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শরিফা সুলতানা বাস করতেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের তেঘুরিয়া স্কুলপাড়ায়। তার পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের আবেদনের পর তদন্ত করতে যান দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার এসআই আরব আলী। শরিফা আরব আলীকে ‘খুশি’ হয়ে ৯০০ টাকা দিয়েছেন। তদন্তে টাকা নেওয়ার বিষয় প্রমাণিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বাস্তার দরিগাঁওয়ে বাস করছেন মো. আলামিন। তার পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন করতে যান ঢাকা জেলার ডিএসবির পরিদর্শক বিষুষ্ণব্রত মল্লিক। পাসপোর্টপ্রত্যাশীর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি। এর প্রমাণ পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেছা হলের নিম্নমান সহকারী রবিন খানের সাইকেল হারিয়ে যাওয়ার পর থানায় জিডি করা হয়। জিডিতে রবিনের নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় জিডির বাদী কী ধরনের সেবা পেয়েছেন তার তদন্ত করে পুলিশ। এতে দেখা যায়, আনোয়ার নামের হলের এক মালিকে ৫০০ টাকা দিয়ে জিডি করতে পাঠিয়েছিলেন রবিন। জিডি করতে যাওয়ার সময় আনোয়ার তার এক সঙ্গীকে নিয়ে যান। যাতায়াত, নাস্তা ও থানার বাইরে রাইটার দিয়ে জিডি লেখাতে ৫০০ টাকা খরচ করেন তিনি। রবিনকে জানান, ওই টাকা তিনি থানায় খরচ করেছেন। তবে তদন্তে দেখা যায়, পুলিশ জিডির জন্য কোনো অর্থ নেয়নি।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, জিডি বা মামলা করতে গিয়ে যাতে কোনো পর্যায়ে কেউ হয়রানির শিকার না হন- এটা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৯টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানার গত ২৪ ঘণ্টার জিডির তথ্য সার্কেল অফিসে পাঠাতে হয়। সকাল ১০টার মধ্যে সার্কেল অফিসার তার অধীন থানার জিডি পর্যালোচনা করে করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন।
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, রেঞ্জ অফিস থেকে অভিযোগকারীর কাছে ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কোনো হয়রানির শিকার হয়েছেন কিনা? জিডি করতে কোনো অর্থ প্রদান করতে হয়েছে কিনা? তাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে কিনা ইত্যাদি। একইভাবে মামলার বাদীর কাছেও ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, তদন্ত কর্মকর্তাকে কোনো অর্থ প্রদান করতে হয়েছে কিনা।
ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আসাদুজ্জামান বলেন, ‘জিডি বা মামলা-সংক্রান্ত ব্যাপারে কাঙ্ক্ষিত পুলিশি সেবা না পাওয়ার অভিযোগ অনেক পুরোনো। থানায় এসে যাতে এ ধরনের হয়রানির শিকার হতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে ঢাকা রেঞ্জ কিছু অভিনব পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা রেঞ্জ অফিসে বসেই সিসিটিভিতে ১৩ জেলার ৯৬ থানার সব কার্যক্রম মনিটর করছি। থানার ডিউটি অফিসার বা গেটে সেন্ট্রিসহ অন্য কোনো পুলিশ সদস্য অমনোযোগী হলে তাৎক্ষণিকভাবে বার্তা পাঠানো হয়।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-