ঘর তালাবদ্ধ করে আগুন দিয়েছিল ডাকাতরা, দাবি রোহিঙ্গাদের

নিজস্ব প্রতিবেদক, টেকনাফ •

বুধবার (১৩ জানুয়ারি) দিবাগত রাত ২টার পরে ঘরটি আগুনে পুড়ছিল। সে সময় বাইরে থেকে ঘরের দরজা তালাবদ্ধ করে দিয়েছিল ডাকাতরা।’ বৃহস্পতিবার দুপুরে নয়াপাড়া নিবন্ধিত ক্যাম্পে পোড়া ঘরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে এই অভিযোগ করেন মাবিয়া খাতুন নামে এক রোহিঙ্গা নারী।এই আগুনে প্রায় ৫শ’ ঘর পুড়ে গেছে।

কক্সবাজারের টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ই-বল্কে মাবিয়া খাতুনের ঘরে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক দিন আগে ডাকাত নবী দলের লোকজন এই ঘর ছেড়ে চলে যেতে হুমকি দিয়েছিল। কারণ তারা আমার ছেলে শওকত আমিনকে তাদের দলের যোগ দেওয়ার জন্য বলছিল। ছেলে রাজি না হওয়ায় বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছিল। তারই অংশ হিসেবে ডাকাত নবী দলের সদস্যরা বুধবার ঘরের বাইরে দরজা তালাবদ্ধ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় চিৎকার দিলে পাশের ঘরের বাসিন্দা মুন্না দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেন। তিনি দরজা খুলে না দিলে আজ আমাদের সবার মৃত্যু হতো। এর আগেও তারা আমার ছেলেকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করেছিল। যে ঘরে আগুন লেগেছিল সেখানে কোনও চুলা এবং বিদ্যুতের সামগ্রী ছিল না।’

এদিকে, এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগুন কীভাবে ধরেছিল সেটি নিশ্চিত হতে পারেনি।

কয়েকজন ভুক্তভোগী রোহিঙ্গা জানান, ‘পাহাড়ি অঞ্চলে ক্যাম্প হওয়ায় ডাকাতরা সেখানে অপরাধ জগৎ গড়ে তুলেছে। বুধবার রাতে নুর নবী ও আবদুল নবী ডাকাত বাহিনীর সদস্যরা সন্ধ্যায় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে টহল দেয়। হয়তো তারাই এ ঘটনা ঘটায়। কারণ এ ক্যাম্প তৈরি হওয়ার পর থেকে এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেনি। পাশাপাশি ঘর হওয়ায় কম সময়ে এত বেশি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

রোহিঙ্গাদের একটি সূত্র বলছে, বুধবার গভীর রাতে নয়াপাড়া নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের ই-ব্লকের বাসিন্দা শওকতকে ‘নবী গ্রুপ’ যার আগের নাম ছিল ‘সালমান শাহ গ্রুপ’ তাদের দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এতে রাজি না হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের বাসার দরজা বন্ধ থাকা অবস্থায় নুর নবী ও আবদুল নবীসহ তাদের গ্রুপের সদস্যরা পুড়িয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে আগুন দেয়। এ আগুনে ঘরগুলোর চাল ও বেড়া পলিথিনের হওয়ায় এবং ঘরে ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার থাকায় সেগুলোর অধিকাংশই বিস্ফোরিত হয়ে আগুন দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়। তবে শওকত এক সময় ডকির ডাকাত গ্রুপের কাজ করছিল বলে দাবি তাদের।

ক্যাম্পে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্যাম্পের আগুনের সূত্রপাতের বিষয়ে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এসেছে। সেটি আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। তা নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কাজ করছে।’

ভুক্তভোগী আজিম উল্লাহ বলেন, ‘শত্রুতার জের ধরে ডাকাত দলের সদস্যরা হয়তো আগুন ধরিয়ে দেয়। যে ঘরে প্রথম অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল তাদের লোকজনকে হুমকি দিয়েছিল ডাকাতদলের সদস্যরা। হয়তো তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছিল।’

‘ক্যাম্পে আগুনে সূত্রপাতের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য আমরা পাচ্ছি’ উল্লেখ করে টেকনাফ নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ মো. আব্দুল্লাহ বিন কালাম জানান, রাত আড়াইটার দিকে আগুন লাগে এবং দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় স্থানীয়ভাবে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়, পাশাপাশি খবর দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিসে। পরে ফায়ার সার্ভিসের দুটি টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ শুরু করে। পরে তারা আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। তবে তার আগেই আগুনে ক্যাম্পের ৮৩ সেডের প্রায় পাঁচশ ঘর পুড়ে যায়। সেখানে ৫৫২ পরিববারের লোকজন বসবাস করছিল।’

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনে পুড়লো ৫০০ ঘর

তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তাৎক্ষণিকভাবে আগুন লাগার কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন খবর আসছে, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ’

টেকনাফ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মকর্তা মুকুল কুমার নাথ বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন লাগার খবর পেয়ে রাত ২টা ৩৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হয়। সাড়ে ৩ ঘণ্টার চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হই। ঘিঞ্জি এলাকা এবং গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হওয়ায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তবে কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয় সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’

টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জরুরি চিকিৎসক চন্দ্রিমা সেন বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে আহত ১৪ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’

ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি, টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ (সিআইসি) আব্দুল হান্নান জানান, তার ক্যাম্পের ৮৩ সেডের প্রায় ৫শ’ ঘর পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্যাম্পের স্কুল সেন্টারে রাখা হয়েছে। দাতা সংস্থার মাধ্যমে তাদের ত্রাণসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হয়েছে।

আরও খবর