বিশেষ প্রতিবেদক ::
কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে ১২টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয় ২০০২ সালে। এরপর ১৮টি বছর কেটে গেলেও এসব বধ্যভূমি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন। কোনো বধ্যভূমিতে স্থাপিত হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ। বধ্যভূমিতে স্থায়ীভাবে সীমানাপ্রাচীর (দেয়াল) নির্মাণ করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের।
মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, চিহ্নিত বধ্যভূমি ১২টি হলেও প্রকৃত সংখ্যা ১৭। বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়ায় মুছে যাচ্ছে ইতিহাস। ইতিমধ্যে চিহ্নিত আটটি বধ্যভূমি দখল করে তৈরি হয়েছে ঘরবাড়ি, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা। অন্য বধ্যভূমিগুলোও দখলের চেষ্টা চলছে।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আবছার বলেন, বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা না হলে মুক্তিযোদ্ধারা সংবর্ধনা নিতে আসবে না—এ রকম আলটিমেটাম দেওয়ার পর প্রশাসনের কর্মকর্তারা উখিয়ার ইনানীতে পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত জায়গাটি দখলমুক্ত করেছিল। কিন্তু টাকার অভাবে কক্সবাজার শহরে ও মহেশখালীসহ জেলার বিভিন্ন স্থানের বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে আলোচনা চলছে।
তিনি বলেন, কক্সবাজার সদরে চিহ্নিত বধ্যভূমি একটি। এটির অবস্থান সমুদ্রসৈকত–সংলগ্ন কক্সবাজার আদর্শ বালিকা কামিল মাদ্রাসার পাশে। এ ছাড়া শহরের রাডার স্টেশন পাহাড়ের নিচে একটি, খুরুশকূলে একটি, নুনিয়াছটা ফিশারিঘাট ও উত্তর নুনিয়াছটায় আরও দুটি বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়নি। টেকনাফেও দুটি বধ্যভূমির মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে একটি।
মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ২০০২ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধারা যৌথভাবে কক্সবাজারের মহেশখালীর পাঁচটি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ১০টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেন। এরপর লাল নিশানা তুলে বধ্যভূমির সীমানা নির্ধারণ করা হয়। পরে ওই নিশানা উধাও হয়ে যায়। এর মধ্যে ছয়টি বধ্যভূমির জমি বেদখলে চলে যাচ্ছে। এসব বধ্যভূমিতে ৮৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল।
মহেশখালী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার খগেন্দ্র লাল শীল বলেন, মহেশখালীর মুন্সিরডেইল, হোয়ানকের পুইছড়ি, কালারমারছড়া বাজার, ঠাকুরতলা আদিনাথ পাহাড়, গোরকঘাটা মাছ বাজার ও দক্ষিণ হিন্দুপাড়া মাতব্বর বাড়ি শ্মশান এলাকার বধ্যভূমিগুলো দখল করে ইতিমধ্যে দোকানপাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে এর সত্যতা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ঠাকুরতলা আদিনাথ পাহাড় এলাকার বধ্যভূমি খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়েছে। সীমানাপ্রাচীর নেই। উত্তর পাশে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি। এসব ঘরে বসবাস করছেন ভাসমান লোকজন। এর পশ্চিম পাশ ব্যবহার হচ্ছে এলাকার কবরস্থান হিসেবে। এ ছাড়া অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে বড় মহেশখালীর দেবেঙ্গাপাড়া, দেবেঙ্গাপাড়া শ্মশান, পালপাড়া ও কায়স্থপাড়া এলাকার বধ্যভূমি।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদস্য আয়ুব বাঙ্গালী বলেন, টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পেছনে নেটং পাহাড়ের পাদদেশে একটি (চিহ্নিত) এবং থানার সামনে আরেকটি বধ্যভূমি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। এসব বধ্যভূমির জমিতেও বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নেটং পাহাড়ের বধ্যভূমির জমিতে ঘরবাড়ি গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ঘরে বসবাস করছেন মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা।
শহীদ পরিবারের কয়েকজন সন্তান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও বীর শহীদদের সম্মান জানানো হচ্ছে না। জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বধ্যভূমির জমি দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। প্রশাসনও প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছে না।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মহেশখালী উপজেলা সংসদের কমান্ডার আমজাদ হোসেন বলেন, বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ না করায় শহীদদের স্মৃতি মুছে যাচ্ছে। বধ্যভূমি সংরক্ষণ করে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন জরুরি।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে উখিয়ার ইনানীতে জাতির জনকের স্মৃতিধন্য স্থানটি দখলমুক্ত করা হয়েছে। অন্যান্য বধ্যভূমি থেকেও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, বধ্যভূমিতে সাইনবোর্ড স্থাপন ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-