ডেস্ক রিপোর্ট •
জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ইতিবাচক অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখছেন কূটনৈতিক বিশ্নেষকরা। তারা বলছেন, বাইডেন এখন পর্যন্ত যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, তার শাসনামলের শুরু থেকেই চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন নিরসনে উদ্যোগ নেবেন। আর চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন কমে গেলে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিশ্বের এ দুই পরাশক্তির যৌথ উদ্যোগেরও সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। এর ফলে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ইতিবাচক অগ্রগতি হতে পারে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, সুনীল অর্থনীতি (ব্লু ইকোনমি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে আরও সুবিধা পেতে পারে বাংলাদেশ।
২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হলে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসে। এর পর থেকেই রোহিঙ্গা সংকট তীব্রতর হয় এবং এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন স্নায়বিক টানাপোড়েনও দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র এ সংকটকে আন্তর্জাতিক সংকট হিসেবে মূল্যায়ন করে, আর মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের উদ্যোগেই রাখাইনে গণহত্যা বিষয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়ারও কথা বলা হয়। তবে চীন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক আলোচনার ওপর জোর দেয়। চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও সে চুক্তি এখন পর্যন্ত কোনো ফল দেয়নি। বরং সংকট সমাধানে আরও জটিলতার সৃষ্টি করেছে। কারণ এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব ভালোভাবে নেয়নি।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা নানা পর্যায়ে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। উল্টোদিকে চীন সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষ নেয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। এ সংক্রান্ত আলোচনার প্রস্তাবে ভেটো দেয় বেইজিং। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার জন্য যে তহবিল, সেখানেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের অংশীদারিত্বই বড়। চীনের অংশগ্রহণ তাদের তুলনায় নগণ্য।
তবে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাসহ মিয়ানমারের ওপর বৈশ্বিক চাপ বৃদ্ধির কারণে চীন রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে শেষ পর্যন্ত কিছু ভূমিকা নেয়। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন আগে নেপিদো সফরে গিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি দ্রুত সম্পন্ন করার তাগিদ দেন।
ওই সফরের পর চীনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিয়ানমারের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পর এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যেগ আসবে। তবে রাখাইনে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়েছে। যেখানে মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে একাধিক বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের এখন জেরবার অবস্থা। একটা বিষয় লক্ষণীয়, রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে। যুক্তরাষ্ট্র এগোলে চীন পিছিয়ে যায়; চীন এগোতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র পেছাতে থাকে। বাইডেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দের অবসান হলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন যৌথ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে এবং সেখানে ভারতকে পাওয়াও সহজ হবে। এর ফলে মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানও সহজ হবে। মিয়ানমারের নির্বাচনে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি আরও বড় ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এলে এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীনের যৌথ উদ্যোগ শুরু করা গেলে রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধানের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হবে।
বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অন্যান্য ক্ষেত্র: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির কারণে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর ফলে বাংলাদেশের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ, বাণিজ্য এবং দেশটির বাজারে পণ্য রপ্তানিতে আরও বেশি সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষ করে বাংলাদেশ বর্তমানে সুনীল অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এ েেত্র যুক্তরাষ্ট্রের বড় বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজারও যুক্তরাষ্ট্র। সারাবিশ্ব থেকে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র দুই থেকে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ৬-৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে মাত্র। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র উন্মুক্ত অর্থনীতির দেশ। ট্রাম্প আমলে এই অর্থনীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত করা হলেও বাইডেন তা আবারও উন্মুক্ত করার কথা জানিয়েছেন। এর ফলে বাংলাদেশের সামনে পণ্য রপ্তানির সুযোগ আরও বাড়ার সম্ভানা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রেমিট্যান্স আয়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এখনও যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেযোগ্য সংখ্যায় অভিবাসী আছেন অনিয়মিত বা অবৈধ। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি ছিল তাদের জন্য কঠোর। বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ অনিয়মিত অভিবাসীকে নিয়মিত করবেন। এটা হলে যুক্তরাষ্ট্রে অনিয়মিতভাবে থাকা বাংলাদেশিরাও উপকৃত হবেন এবং রেমিট্যান্সেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকেই অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন এবং তার সিদ্ধান্ত, বক্তব্য দেশটির অভ্যন্তরেও নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ফলে ট্রাম্প আন্তর্জাতিক পরিসরে নজর কম দিয়েছেন। তা ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য খুব বেশি সহজ ছিল না। এসব কারণে ট্রাম্প আমলে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি রক্ষণশীল হয়ে পড়ে এবং এর ফলে বিশ্বনেতৃত্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকে।
তিনি বলেন, বাইডেন তার বক্তব্যে বিশ্বনেতৃত্বের জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পুনরুদ্ধার এবং চীনের সঙ্গে ‘কো-অপারেশন অ্যান্ড কম্পিটিশন’ নীতির যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটাই সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। চীনের সঙ্গে টানাপোড়েনের জায়গাটা কমলে বাংলাদেশের মতো দেশের সামনে উভয় দেশের সঙ্গেই বিনিয়োগ, বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক আরও বাড়ানো সহজ হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-