ইমাম খাইর ◑
ভাসানচরে যাওয়ার চেয়ে নিজ দেশে ফিরতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গারা। সেখানকার পরিবেশ, অবকাঠামো নিয়ে তাদের কেউ কেউ প্রশংসা করলেও স্থায়ীভাবে থাকতে রাজি নয় তারা। তাদের ফেরার আগ্রহ স্বদেশভূমি মিয়ানমারে।
সম্প্রতি তিন নারীসহ রোহিঙ্গাদের ৪০ জনের একটি প্রতিনিধি দল নোয়াখালীর হাতিয়া ভাসানচর পরিদর্শনে যান। দেখেছেন সেখানকার থাকার ঘর, খাদ্য গুদাম, খেলার জায়গা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল, মসজিদ, কবরস্থান, পুকুর, আশ্রয়কেন্দ্র ইত্যাদি। দুইদিন পর ক্যাম্পে ফিরে অনুভূতি প্রকাশ করেন রোহিঙ্গা নেতারা। জানালেন অনেক তথ্য ও অভিজ্ঞতা।
মৌলভী আবুল কালাম জানান, ভাসানচরে অনেক কিছু দেখেছেন। তা সুন্দর লেগেছে। অন্যান্য রোহিঙ্গাদের তারা এসব বুঝাচ্ছেন। আরেক রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, দু’চারজনে শান্তি বুঝালে হবে না। তাদের দশজন যেদিকে তিনিও সেদিকে। তার একার কোনো মত নেই। তবে, সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় সবদিক বিবেচনা করে নেয়া দরকার। সাধারণ রোহিঙ্গাদের মত ভিন্ন। তারা কোনোমতেই ভাসানচরে যেতে রাজি নয়। তাদের মতে, ভাসানচর একটি দরিয়া। এই দরিয়ার মাঝে যাবে না তারা। প্রয়োজনে ক্যাম্পে না খেয়ে থাকবে।
উখিয়া ক্যাম্প-১৯, ব্লক-ডি-১২ তে থাকেন ছলিমা নামক পঞ্চাশোর্ধ মহিলা। তার সঙ্গে কথা হলে জানান, তার মেয়ে নুর কায়েদার সাথে মালয়েশিয়ার এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে ৩ বছর আগে। স্বামীর দেখিয়ে দেয়া দালালের হাত ধরে বোটে করে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে ধরা পড়ে। সে বর্তমানে ভাসানচরে আছে। প্রথমদিকে ফোনে কথা বললেও এখন মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নাই। ওই সময় মেয়ে নুর কায়েদা জানিয়েছিল, ভাসানচর তাদের জন্য এক প্রকার বন্দিশালা। পরিবারের কেউ যেন ওখানে না যায়। মেয়ের কথার সূত্র ধরে ছলিমাও ভাসানচরের বিপক্ষে। তার মতে, যতদিন আছে ক্যাম্পেই থাকবে। অন্য কোথাও যেতে রাজি নয় তারা।
একই কথা নুরুল আমিন নামক ষাটোর্ধ এক রোহিঙ্গার। তার মতে, ভাসানচরে পাঠানোর চেয়ে কোনো একটি পাহাড়ে ফেলে দিলে অনেক ভালো হবে। ক্যাম্পে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকতে চায় তারা।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। তাই উখিয়া ও টেকনাফের ওপর চাপ কমাতে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিতে চায় সরকার। আর এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিশিষ্ট জনেরা।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী জানান, জনসংখ্যার আধিক্য বিবেচনা করে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিতে সরকারি সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত। এটি একটি সুন্দর আয়োজন। রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরত না যাওয়া পর্যন্ত ভাসানচরে যাওয়াটাই উচিত ও যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন তিনি।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দ্দৌজা জানান, বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার করা ৩০৬ জন রোহিঙ্গা এখন ভাসানচরে ভালোই আছেন। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি দল ভাসানচর ঘুরে দেখেছেন। সেখানে অবস্থানরতদের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। স্বচক্ষে সব পরিবেশ দেখেছেন।
সূত্র জানায়, ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার–জলোচ্ছ্বাস থেকে এই চরের ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ তৈরি করেছে। এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য সেখানে ১২০টি গুচ্ছ গ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। বাড়তি টাকা ভাসানচর রক্ষাকারী বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো, আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা, জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হবে। বরাদ্দ বাড়ার ফলে ভাসানচর রক্ষাকারী বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা হবে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর দমন-নিপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরের কয়েক মাসে প্রাণ বাঁচাতে অন্তত সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরের দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে আরও ৭৮ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থান নেয়া এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলো সর্বোচ্চ মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-