আদনান সাকিব ◑
বন্দুকযুদ্ধের নামে কখনো মায়ের সামনে ছেলেকে, বোনের সামনে ভাইকে আবার কখনো কখনো স্ত্রীর সামনে স্বামীকে ধরে নিয়ে ‘খুন’ করেছেন টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।
তার ভয়ে কেউ-ই মুখ খুলতে পারিননি। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় প্রদীপ কুমার দাশ গ্রেফতার হওয়ার পর ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। অনেকেই আইনের আশ্রয় নিয়েছেন আবার কেউ কেউ নিচ্ছেন। ফলে প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে।
কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের আদালতে প্রদীপের বিরুদ্ধে এরইমধ্যে ১৪টি মামলা হয়েছে। এর বেশির ভাগই করা হয়েছে প্রদীপ ও তার বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময়ে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত পরিবারের পক্ষ থেকে।
শুধু প্রদীপের আমলেই টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে ১০৬টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ১৭৪ জন নিহত হয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার ঘটনা তদন্তে গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিটির সদস্যদের সামনে প্রদীপ নিজেই স্বীকার করেছেন, বন্দুকযুদ্ধগুলোর বেশির ভাগই তার নেতৃত্বে হয়েছে। কমিটি জানতে চেয়েছিল, আপনি কতবার নিজে গুলি করেছেন, কী অস্ত্র দিয়ে গুলি করেছেন? জবাবে প্রদীপ বলেছেন, তিনি ২০-৩০ বার গুলি করেছেন, ব্যক্তিগত অস্ত্র দিয়ে।
প্রদীপের কাছে কমিটি জানতে চায়, আপনি কি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, নাকি অধীনস্থদের পেছনে থাকেন? জবাবে প্রদীপ বলেন, ‘আমি সামনে থেকেই পরিচালনা করি।’
অন্যদিকে, ১০ সেপ্টেম্বর সবশেষ ওসি প্রদীপসহ ৫৬ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের আদালতে দুইটি মামলা করা হয়। দুইটি মামলাই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যার অভিযোগ সংক্রান্ত। বন্দুকযুদ্ধের নামে আব্দুল আমিন ও মফিদ আলমকে হত্যার অভিযোগে প্রদীপ কুমার দাশসহ ৫৬ জনের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা হয়েছে। মামলা দুইটি করেন নিহত আব্দুল আমিনের ভাই নুরুল আমিন ও মফিদ আলমের ভাই মো. সেলিম।
নুরুল আমিন এজাহারে উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তার ভাই আব্দুল আমিনকে আটক করে পুলিশ। এরপর পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। ৫০ হাজার টাকা দেয়ার পরও ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে হত্যা করা হয় আব্দুল আমিনকে। এ মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৮ জনকে। এরমধ্যে ৩০ পুলিশ সদস্য রয়েছেন।
অন্যদিকে মফিদ আলম নিহতের ঘটনায় মো. সেলিম এজাহারে বলেছেন, ২০১৯ সালের ১১ জুলাই তার ভাইকে আটক করা হয়। এরপর দাবি করা ১৫ লাখ টাকার মধ্যে ছয় লাখ টাকা দেয়ার পরও ১৪ জুলাই হত্যা করা হয় মফিদ আলমকে। এ মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৮ জনকে। এরমধ্যে ১৬ জন পুলিশ।
সাম্প্রতিক সময়ে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি হয় ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের ঘটনায়। মামলাটি করেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এ মামলায় প্রদীপ কুমার দাশকে ২ নম্বর আসামি করা হয়।
ওই মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর প্রদীপকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাব তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। দুদকের করা মামলায় আদালতে হাজির করাতে ১২ সেপ্টেম্বর সকালে তাকে কক্সবাজার কারাগার থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।
২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের চন্দনাইশের দুই ভাই আমানুল হক ফারুক ও আজাদুল হক আজাদকে অপহরণ করে আট লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে, না পেয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগে প্রদীপসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়। চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমীর আদালতে মামলাটি করেন নিহতের ছোট বোন রিনাত সুলতানা শাহীন। চন্দনাইশ থানার ওসি কেশব চক্রবর্তীর যোগসাজশে প্রদীপ ওই দুই ভাইকে তুলে নিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগ করেন নিহতদের স্বজনরা। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়।
৮ সেপ্টেম্বর প্রদীপ কুমার দাশসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন নির্যাতিত স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান। সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানের করা মামলায় ওসি প্রদীপসহ পুলিশ সদস্য ও তাদের দালালদের মাধ্যমে চার দফা ঘটনায় নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন, হত্যাচেষ্টা এবং মিথ্যা মামলাসহ নানা অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
৭ সেপ্টেম্বর টেকনাফের নূর মোহাম্মদ ও মো. আজিজ নামে দুইজনকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যার অভিযোগে কক্সবাজারের আদালতে দুইটি মামলা করা হয়। নূর মোহাম্মদের স্ত্রী লায়লা বেগম ও মো. আজিজের মা হালিমা খাতুন মামলা দুইটি করেন। এতে ওসি প্রদীপসহ ৩১ জনকে আসামি করা হয়।
২০১৯ সালে টানা ছয় মাস থানায় আটকে রেখে ছয় লাখ টাকা আদায় করেও পরে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয় অটোচালক জলিলকে। এ ঘটনায় চলতি বছরের ২৭ আগস্ট ওসি প্রদীপসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের আদালতে মামলা করেন অটোচালক জলিলের স্ত্রী ছানোয়ারা বেগম।
পাঁচ লাখ টাকা আদায় করে আরো পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ না পাওয়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলার যুবক সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করেন ওসি প্রদীপসহ ২৮ জন। এ অভিযোগে ১৮ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহতের মা গুল চেহারা। আদালতের বিচারক এজাহার আমলে নিয়ে একজন এএসপি পদমর্যদার অফিসারকে দিয়ে তা তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন।
পাঁচ লাখ টাকা আদায় করে দাবি করা আরো পাঁচ লাখ টাকা না দেয়ায় টেকনাফের প্রবাসী মাহামুদুল হককে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেন টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ তার বাহিনী। এ মামলায় ২৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে এজাহার করা হয়েছে। টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউপির মিয়া হোসেনের ছেলে নুরুল হোছাইন মামলাটি করেন। আদালত এজাহারটি পর্যালোচনা করে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাহামুদুল হক নিহতের ঘটনায় টেকনাফ থানায় করা মামলার বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেয়।
টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে একসঙ্গে তিনজনকে হত্যার অভিযোগ এনে ওসি প্রদীপকে প্রধান আসামি করে ৩১ আগস্ট ৪১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন টেকনাফের রঙ্গিখালীর বাসিন্দা সুলতানা রাবিয়া মুন্নী।
এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, তার স্বামী সৈয়দ আলম, সৈয়দ আলমের আপন ভাই নুরুল আলম ও তাদের ভাগিনা সৈয়দ হোসেনকে ৬ মে রাত ২টায় নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় আসামিরা। পর ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও এসআই মশিউর রহমান ওই তিনজনের পরিবারের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে ওই তিনজনকে তাদের বসতবাড়ির পশ্চিম পাশে পাহাড়ের নিচে ধানক্ষেতে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করে। এছাড়া আসামিরা তিনজনের বাড়িতে গভীর রাতে সশস্ত্র অবস্থায় ঢুকে লুটপাট, ভাঙচুর ও বাড়ির মানুষদের মারধর করে।
আদালত এজাহারটি আমলে নিয়ে এ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় এরইমধ্যে কোনো মামলা হলে তার সবশেষ অবস্থা ও অগ্রগতির প্রতিবেদন ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে টেকনাফ থানার ওসিকে আদেশ দেয়।
২৩ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দীন। এ মামলায় ২৭ আগস্ট মহানগর সিনিয়র স্পেশাল দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমানের আদালতে প্রদীপ কুমার দাশকে গ্রেফতার দেখানোর আবেদন জমা দেয়া হয়। আদালত ১৪ সেপ্টেম্বর আদেশের শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করে।
মামলার এজাহারে প্রদীপ কুমার দাশ ও চুমকির বিরুদ্ধে প্রায় চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়েছে। এরমধ্যে তিন কোটি ৯৫ লাখ পাঁচ হাজার ৬৩৫ টাকা ওসি প্রদীপ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে দুদক অভিযোগ এনেছে। আরো ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য বিবরণীতে গোপন করার অভিযোগও আনা হয়েছে চুমকির বিরুদ্ধে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-