মুহাম্মদ আলী জিন্নাত, ডেইলী স্টার ◑
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের একমাস পূর্ণ হলো আজ। হত্যার এ ঘটনা সারাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দুটি তদন্ত কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে একটি প্রশাসনিক, অপরটি মামলার আইনগত তদন্ত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গত ৩ আগস্ট থেকে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। এর পাশাপাশি এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আদালতে করা মামলার তদন্ত কার্যক্রমও চলছে।
কক্সবাজারের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলেছে সিনহা নিহতের বিষয়টি নিয়ে। তাদের অনেকের অভিমত- সিনহা হত্যা মামলাটি যেহেতু একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মামলা, তাই এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে একটু বেশি সময় হয়তো তদন্তকারী কর্মকর্তার লাগতেই পারে। মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি যথাসময়ে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবে এবং তা জনসাধারণের জানার জন্য প্রকাশ করা হবে- এটিই প্রত্যাশা তাদের।
নাগরিক সংগঠন ‘আমরা কক্সবাজারবাসী’র সমন্বয়ক মো. করিম উল্লাহ কলিম বলেন, ‘সাধারণত সরকারের বিভিন্ন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জনগণের জানার সৌভাগ্য খুব কমই হয়। তবে আমরা প্রত্যাশা এবং দাবি করছি, সিনহার মৃত্যুজনিত ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন যথাসময়ে প্রকাশ করা হোক। মানুষ প্রকৃত সত্যটা জানুক।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস ফোরাম কক্সবাজারের যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুস শুক্কুর বলেন, ‘সবাই যাতে ন্যায়বিচার পায়, তার জন্য হত্যামামলার বিচারিক কার্যক্রম যেমন যথাসময়ে সম্পন্ন করা প্রয়োজন, তেমনি প্রশাসনিক কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিতে দেরি হওয়া সমীচীন নয়।’
গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর এপিবিএন তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা নিহত হন। তার মৃত্যুর পর, এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে গত একমাস কক্সবাজার ছিল ঘটনাবহুল।
সিনহা হত্যার ঘটনায় গত ১ আগস্ট টেকনাফ থানায় পুলিশ বাদি হয়ে দুটি মামলা করে। একটি মাদক আইনে এবং অপরটি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে। মামলার বাদি হন, বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন উপপরিদর্শক নন্দদুলাল রক্ষিত। দুটি মামলায় আসামি করা হয় সিনহার সঙ্গে থাকা স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে। তাকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই দিন রামু থানায় পুলিশ বাদি হয়ে আরেকটি মাদক আইনে মামলা করে সিনহার ভিডিও নির্মাণ দলের আরেক সদস্য একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিপ্রা রাণী দেবনাথকে আসামি করে। তাকে ৩১ জুলাই রাতে আটক করা হয় হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্ট থেকে।
২ আগস্ট সিনহা হত্যার ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রথমে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শাজাহান আলীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। পরে এ কমিটি বাতিল করে চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
৩ আগস্ট থেকে এই কমিটি কাজ শুরু করে।
৫ আগস্ট মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদি হয়ে পুলিশের নয় সদস্যকে আসামি করে কক্সবাজার আদালতে হত্যা মামলা করেন। আদালত বাদির করা এজাহারটিকে সরাসরি হত্যা মামলা হিসেবে রুজু করার জন্য টেকনাফ থানার ওসিকে আদেশ দেন। ওইদিন রাতে আদালতের আদেশনামা টেকনাফ থানায় পৌঁছে এবং ৯ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।
৬ আগস্ট মামলায় অভিযুক্ত সাত আসামি- প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী, নন্দদুলাল রক্ষিত, লিটন মিয়া, সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাদের প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করলে প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী ও নন্দদুলাল রক্ষিতের প্রত্যেকের সাত দিনের রিমান্ড এবং অপর চার আসামিকে দুই দিন কারা ফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন আদালত।
৮ আগস্ট আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মামলার চার আসামি- লিটন মিয়া, সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুনকে জেলা কারাগার ফটকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
৯ আগস্ট চার আসামিকে দ্বিতীয় দিনের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কারা ফটকে। ওই দিন সিনহার টিমের সদস্য শিপ্রা রাণী দেবনাথকে জামিন দেন রামু উপজেলা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত। সেদিনই সিনহার টিমের আরেক সদস্য সাহেদুল ইসলাম সিফাতের জামিন আবেদন করা হয় আদালতে। পাশাপাশি টেকনাফ থানায় সিফাতের বিরুদ্ধে করা দুটি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করে তদন্তের দায়িত্ব র্যাবকে দেওয়ার আবেদন করা হয়। এসব আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জামিন ও তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তনের শুনানির দিন ধার্য করেন আদালত।
১০ আগস্ট সিফাত দুটি মামলায় জামিন পান। টেকনাফ থানায় পুলিশের করা দুটি মামলার আগের তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করে তদন্তের ভার দেওয়া হয় র্যাবের উপর। সিনহা হত্যা মামলার চার আসামি- পুলিশের এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ড চাওয়া হয় ওই দিন। আদালত এই আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করেন ১২ আগস্ট।
১১ আগস্ট সিনহার সহযোগী সিফাত ও শিপ্রা জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর প্রথমবারের মতো কথা বলেন গণমাধ্যমের সামনে। মারিশবনিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দীন ও আয়াছ উদ্দীনকে গ্রেপ্তার ও আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদনও করা হয় ১১ আগস্টে। এই রিমান্ড আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করা হয় ১২ আগস্ট।
১২ আগস্ট কক্সবাজারের আদালত পুলিশের চার সদস্য- এএসআই লিটন, কনস্টেবল সাফানুর, কামাল ও মামুন এবং মারিশবনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দীন ও আয়াছ উদ্দীনকে সাত দিন করে রিমান্ডে দেন। এই দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি গণশুনানির জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দেয়।
১৪ আগস্ট লিটন, সাফানুর, কামাল, মামুন এবং নুরুল, নিজাম ও আয়াছকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কারাগার থেকে র্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়।
১৫ আগস্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম প্রথমবারের মতো শামলাপুরের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
১৬ আগস্ট শামলাপুরে মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির গণশুনানির আয়োজন করা হয়। কয়েক হাজার উৎসুক মানুষের উপস্থিতি হয় সেখানে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ১১ জন সেখানে সাক্ষ্য দেন।
১৭ আগস্ট কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ তিন এপিবিএন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানান।
১৮ আগস্ট এপিবিএনের তিন সদস্য- সহকারী উপপরিদর্শক শাহাজাহান, কনস্টেবল রাজীব ও আবদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত তাদের প্রত্যেককে সাত দিন করে রিমান্ডে দেন। মামলার প্রধান তিন আসামি লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার ও নন্দদুলাল রক্ষিতকে কারাগার থেকে র্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়।
১৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, রিমান্ডে থাকা চার পুলিশ সদস্য ও তিন গ্রামবাসী ঘটনার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
২১ আগস্ট হত্যা মামলার তিন আসামি লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ ও নন্দদুলাল রক্ষিতকে নিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার শামলাপুর ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
২২ আগস্ট এপিবিএনের তিন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কারাগার থেকে র্যাব হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৪ আগস্ট সাত পুলিশ সদস্য- লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ, নন্দদুলাল রক্ষিত, লিটন মিয়া, সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রত্যেকের সাত দিন করে রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত।
২৫ আগস্ট মারিশবনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দীন ও আয়াছ উদ্দীনকে চার দিন করে রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত।
২৬ আগস্ট সিনহা হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ১৩ আসামির মধ্যে এপিবিএন সদস্য আবদুল্লাহ প্রথম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
২৭ আগস্ট আদালতে এপিবিএনের অপর দুই সদস্য শাহাজাহান ও রাজীব স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
২৮ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী ও নন্দদুলাল রক্ষিতের তৃতীয় দফায় প্রত্যেককে তিন দিন করে রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত।
২৯ আগস্ট টেকনাফ থানায় পুলিশের করা মামলার তিন আসামি নুরুল আমিন, নিজাম ও আয়াছ উদ্দীনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কারাগার থেকে চার দিনের হেফাজতে নেয় র্যাব।
৩০ আগস্ট মামলার প্রধান আসামি, বহিষ্কৃত পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
৩১ আগস্ট মামলার তিন নম্বর আসামি উপপরিদর্শক নন্দদুলাল রক্ষিত আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন এবং আসামি প্রদীপ কুমার দাশকে আদালতের নির্দেশে আরও একদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের মৃত্যুজনিত ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে। সদস্য করা হয় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল এসএম সাজ্জাদ হোসেন, পুলিশের প্রতিনিধি পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক জাকির হোসেন খান ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শাজাহান আলীকে।
এ কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলে মন্ত্রণালয়। সে হিসেবে গত ১০ আগস্ট প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্ধারিত দিন ছিল। কমিটি সময় বাড়ানোর আবেদন করলে মন্ত্রণালয় ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সময় বাড়ায়।
এরপর কমিটি আবারও সাত দিন সময় বাড়ানোর আবেদন করে। মন্ত্রণালয় পুনরায় সময় বাড়িয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন নির্ধারণ করে দেয় ৩১ আগস্ট। কমিটি ৩০ আগস্ট আরও কয়েকদিন সময় চেয়ে আবেদন করে মন্ত্রণালয়ে।
সিনহা রাশেদ নিহত হওয়ার পর চার আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিনহার মা নাসিমা আক্তারকে ফোন করে সমবেদনা ও সান্তনা জানান এবং সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দেন।
২ আগস্ট যশোর সেনানিবাসের কবরস্থানে সিনহাকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় দাফনের সময় তার মা একমাত্র পুত্র সন্তানকে নিয়ে আবেগঘন বক্তব্য দেন। ওই সময় তিনি বলেন, তার সন্তান জাতীয় বীর।
সিনহা রাশেদ নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ৫ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজীজ আহমদ ও বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমদ একসঙ্গে কক্সবাজার পরিদর্শন করেন। তারা শামলাপুর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-