বাংলা ট্রিবিউন ◑
গন্তব্য ছিল কক্সবাজারের টেকনাফ আলীখালী রোহিঙ্গা শিবির। কিন্তু হঠাৎ করে নামা প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে মোটরসাইকেলের গতি কমিয়ে ঢুকে পড়ি নতুন লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতরে। করোনাকাল। কিন্তু, রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রিপল ঘেরা চায়ের দোকানে উপস্থিতির কমতি নেই। তবে এখানে শারীরিক দূরত্বের বিষয়টাও মানা হচ্ছে। তবে সবাই মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। ত্রিপলের নিচে চায়ের আড্ডা জমিয়ে রেখেছেন এক ব্যক্তি। তিনি বলছেন, অন্যরা শুনছেন। ঢুকে পরিচয় বিনিময় হলে জানা গেলো ইনি রোহিঙ্গা নেতা মোস্তফা কামাল। তার পাশাপাশি বসা অন্যরাও রোহিঙ্গা নেতা। তাদের নাম মো. ইউনুছ, জাফর আলম ও মাস্টার নুর আলম। এরা সবাই এ ক্যাম্পের শিক্ষিত ব্যক্তি বলে বাকিরা মানেন তাদের। রোহিঙ্গা নেতারা ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে তাদের আসার তিন বছর পূর্তি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে তাদের আলোচনায় মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার প্রসঙ্গটাও কানে এলো। ঠিক তখনই তাদের আলোচনায় ঢুকে পড়ি। বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই, আসলেই কি তারা মিয়ানমারে ফিরতে চান?
প্রসঙ্গটা শুনে থামলেন বক্তা মোস্তফা কামাল। পরিচয় বিনিময়ের পর এ প্রশ্নের জবাবে জানালেন, ‘মিয়ানমার সরকারকে বিশ্বাস করা যায় না। এর আগেও তারা অনেকবার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। এখন কেবল একটাই চাওয়া যে দেশে আশ্রিত হয়েছি, সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) দেওয়া প্রস্তাবগুলো তারা মেনে নিক। এ প্রস্তাবগুলো ওরা (মিয়ানমার সরকার) মানলে আমরা মিয়ানমারে ফিরতে পারি।’
শনিবার (২২ আগস্ট) দুপুরে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান কক্সবাজারের টেকনাফের নতুন লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মোস্তফা কামাল। তিনি মিয়ানমারে মংডু হাসসুরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। গত ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টে সেদেশের সেনা অভিযানের মুখে রোহিঙ্গাদের ঢলের সঙ্গে পরিবার নিয়ে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
আজ মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তিন বছর পূর্তি। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বিপুল এলাকাজুড়ে সেসময় মাত্র কয়েক মাসের মাথায় যে সাত লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল, তিন বছরে তাদের একজনকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।
মোস্তফা কামাল (৫০) তাদের রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের যে অবদান তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন , ‘বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মৃত্যুকূপ থেকে রক্ষা করে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেখানে আবার কিভাবে জেনেশুনে মৃত্যুকূপে ফিরি! তাই আমাদের একটাই চাওয়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে শুরুতে যে পাঁচ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন, মিয়ানমার সেগুলো মেনে নিক। মেনে নিলে ফিরে যেতে আমরা প্রস্তুত।’
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২০১৭ সালে ৫ দফা প্রস্তাব রাখেন প্রধানমন্ত্রী।
পরে ২০১৯ সালে আবারও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তার অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেন জাতিসংঘের অধিবেশনে। তবে ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা নিপীড়িত হওয়ার পরপরই ২৫ আগস্ট বাংলাদেশের সীমান্ত রোহিঙ্গাদের জন্য উন্মুক্ত করে ৮ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার পর সেবছরেরই ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ অধিবেশনে মিয়ানমারের উদ্দেশে যে পাঁচ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা তাই মনে গেঁথে আছে রোহিঙ্গা নেতা মোস্তফার। গড় গড় করে সেই প্রস্তাব বলে যান তিনি:
১. অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা
২. অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা
৩. জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা
৪. রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা
৫. কোফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা
রোহিঙ্গা নেতা মোস্তফা বলে যান, ‘রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানিতে যে প্রাথমিক রায় এসেছে, এতে আমরা অনেক আশাবাদী। এই মামলার ফলে রোহিঙ্গাদের অনেকে সাহস পেয়েছে যে তারা একদিন মিয়ানমারে ফিরতে পারবে।’
তিনি বলে যান, ‘এটাই সত্যিই যে বিশ্বের যে কোনও দেশে কোনও জনগোষ্ঠীর ওপর ‘জেনোসাইড’ করলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এটি তার একটি উদাহরণ। এতে অনেকে শিক্ষা পাবে এবং এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকবে।’
২০১৭ সালের আগস্টের মাঝামাঝি পুলিশ ক্যাম্পে হামলার একটি ইস্যুকে সামনে ধরে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতে রাখাইনে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী একের পর এক অপরাধ ঘটাতে থাকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং তাদের সমর্থনে বৌদ্ধ বিভিন্ন সম্প্রদায়। ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এই হামলায় প্রাণ বাঁচাতে ২৫ আগস্টের পর সোয়া সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে আসে আশ্রয়ের সন্ধানে। বাংলাদেশ সরকর মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিলেও এর আগে থেকেই কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছিল প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। রাখাইনের এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বলছে জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে চলছে এ মামলার বিচার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর চুক্তি সই করে। পরে দুই দেশ ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ নামে চুক্তি করে। ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ অনুযায়ী, প্রত্যাবাসন ওই চুক্তির কাজ শুরুর দুই বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় চীনের সরাসরি মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সর্বশেষ গত বছরে ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করে। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম তারিখ ঠিক হয়েছিল। কিন্তু দুটি চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তিন বছর পূর্তি হয়ে গেলেও এখনও প্রত্যাবাসন সম্ভব হলো না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মাহাবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘মিয়ানমারের কারণে এখনও প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। আমাদের চেষ্টা থাকবে যে স্বেচ্ছায় কিভাবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়। তবে এর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার ওপর আরও চাপ দিতে হবে।
টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের আরেক রোহিঙ্গা জাফর আলম (৪৫) বলেন,‘এটা আমার দেশ নয়, নিজ দেশ মিয়ানমার চলে যেতে হবে। এমনভাবে যেতে চাই, যাতে আর কখনও ফিরে আসতে না হয়। আমাদের সরকারের কাছে নাগরিকত্বসহভিটে-বাড়ি ও জমি-জমা ফেরত চাই। মিয়ানমারে বসবাসকারী ১৩৫ জনগোষ্ঠীর মতো রোহিঙ্গাদেরও স্বীকৃতি, গণহত্যাকারীদের বিচারের মাধ্যমে সাজা নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা পেলে দেশে ফিরে যাবো আমরা।’
এর আগে এনভিসি কার্ড নয় সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান, ভিটে-বাড়ি ও জমি-জমা ফেরত, আকিয়াব জেলায় আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িতে ফেরত, কারাগারে বন্দি রোহিঙ্গাদের মুক্তি, হত্যা, ধর্ষণের বিচার, অবাধ চলাফেরা, নিরাপত্তা প্রদানসহ একাধিক শর্ত পূরণ না হওযায় স্বদেশ ফিরে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিল রোহিঙ্গারা।
এখানে কথা হয় এক রোহিঙ্গা কিশোর আব্দুল্লাহর সঙ্গে। ‘রাইট’ নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চায় উল্লেখ করে রোহিঙ্গা কিশোর আবদুল্লাহ (১৩) বলে, ‘ক্যাম্পবন্দি জীবন কি জীবন? রোহিঙ্গাদের ওপর জুলুম নির্যাতনকারীদের বিচার হতে হবে। আমাদের নাগরিকত্ব ফেরত দিতে হবে। মিয়ানমার আসলে কেমন দেশ? যে মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়।’
এই কিশোর আক্ষেপ করে বলে, ‘জানি না বিশ্বের আর কোনও দেশে রোহিঙ্গাদের মতো কোনও নির্যাতিত জাতি আছে কিনা?’
চা দোকান ছাড়তেই দেখা হয় পঞ্চাশের বেশি বয়সী নূর নাহার নামে এক রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে। দেশে ফিরতে চান কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শান্তির বার্তা নিয়ে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে চাই। যাতে আর পেছনে তাকাতে না হয়।’
এজন্য রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি, ভিটে-বাড়ি ও জমি-জমা ফেরত, কারাবন্দিদের মুক্তি, মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, নিজ নিজ গ্রামে বসবাস, নির্যাতনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটা এবং রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।
লেদা রোহিঙ্গা শিবির ছাড়ার পর কথা হয় টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আলমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে। তিনি বলেন, ‘তিন বছরে প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হচ্ছি। মূলত মিয়ানমারের মিথ্যাচারের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া ক্যাম্পে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় কক্সবাজারের জন্য বিপদ বাড়ছে। প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে এই প্রধান সমস্যার সমাধান ছাড়া আর কোনও পথ নেই।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-