আবুল খায়ের ◑
করোনা মহামারি মোকাবিলার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার ঘটনা নিয়ে কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন ব্যস্ত। এতে চাপা পড়ে যাচ্ছে ইয়াবা গডফাদারদের নাম। ইতিমধ্যে গডফাদার ও মাদক ব্যবসায়ীরা চলে এসেছে নিজ নিজ এলাকায়।
সৌদি আরব, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যারা আত্মগোনে ছিল, সেই সব গডফাদার ও মাদক ব্যবসায়ী টেকনাফে গিয়ে দেদার চালাচ্ছে ইয়াবা ব্যবসা। ইয়াবার বড় বড় চালান আসছে এখন। সম্প্রতি কয়েক দিনে ইয়াবার যেসব চালান এসেছে, তা বিগত এক বছরেও আসেনি।
ইয়াবার উত্সভূমি হিসেবে পরিচিত মিয়ানমার। আর বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট কক্সবাজার। সারা দেশে ইয়াবার ৮০ ভাগ সরবরাহ হয় টেকনাফ থেকে। নেশার ভয়ানক ছোবল ক্রেজি ড্রাগ হিসেবে পরিচিত ছোট্ট আকারের এই বড়ি ব্যবসায়ের গডফাদার ৫৪ জন। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে দেশের সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইয়াবা প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করলেও অধিকাংশ গডফাদার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় দিনে দিনে ইয়াবা সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কক্সবাজারের কোথাও না কোথাও প্রায়ই ইয়াবার বড় বড় চালান ধরা পড়ছে। কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে গ্রেফতারকৃতরা ছাড়া পেয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির কর্মকর্তারা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পায়। কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে বাদ দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা করা অসম্ভব।
সিনহা হত্যাকাণ্ড এবং করোনা থেকে মানুষের জীবন রক্ষার মতো কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যস্ততার সুযোগ নিচ্ছে মাদক কারবারিরা। নিত্যনতুন কৌশলে মাদকের চোরাচালান রাজধানীতে আসছে এই দুর্যোগকালেও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রায় দিনই একাধিক চালান উদ্ধার ও বহনকারী গ্রেপ্তার হলেও যেন অপ্রতিরোধ্য মাদক কারবারিরা! প্রায় প্রতি দিনে পরিত্যক্ত অবস্থায় মাদকের বড় চালান উদ্ধার হলেও মালিকেরা গ্রেফতার হয় না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এসব চালানের মালিক মোটা অঙ্কের টাকার বিমিনয়ে ছাড়া পেয়ে যায়। আর চালানকে দেখানো হয় পরিত্যক্ত অবস্থায়। এই কায়দায় একশ্রেণির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মোটা অঙ্কের উেকাচ বাণিজ্য করে আসছে। করোনা ভাইরাস আতঙ্কের মধ্যে সব দেশের সীমান্ত পাহারা এখন অনেকটাই ঢিলেঢালা। এর সুযোগ নিচ্ছে মাদক কারবারিরা। মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে ইয়াবার চালান আসছে। সাগর, পাহাড় আর সড়কপথে নানা কৌশলে পাচার হচ্ছে এই ভয়ংকর নেশার ট্যাবলেট।
র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে টেকনাফ এলাকায় মাদক কারবারিরা সুযোগ নিতে পারে। কোনো অবস্থাতেই মাদক কারবারিরা যাতে সুযোগ নিতে না পারে, সেজন্য ঐ এলাকায় দায়িত্ব পালনরত র্যাব সদস্যদের সতর্ক করা হয়েছে। মাদক নির্মূলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ইয়াবা ব্যবসার উর্বর ভূমি টেকনাফ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এখানকার ঘরে ঘরে বিস্তার লাভ করেছে ইয়াবা ব্যবসা। এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের হাত ধরে এই মাদকের বিস্তার ঘটেছে। এদের কেউ কেউ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের গডফাদার। আবার বড় একটা অংশ সরাসরি ব্যবসার সঙ্গেই জড়িত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন সংস্থার তালিকায় কক্সবাজার জেলার যে ১ হাজার ১৫১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে, তার মধ্যে ৯ শতাধিক ব্যবসায়ী হচ্ছে নাফ নদীতীরের সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফের।
এর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় ৫৪ জন ইয়াবা গডফাদারের নাম রয়েছে। গত বছরের প্রথম দিকে শুরু হওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের কারণে এই ইয়াবা ব্যবসায়ীর বড় অংশই আত্মগোপনে চলে যায়। মাঝেমধ্যে দু-এক জন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলেও অন্যদের কোনো সন্ধানই পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এখন ইয়াবা গডফাদাররা এলাকায় দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
টেকনাফ প্রতিনিধি সরেজমিন টেকনাফ উপজেলা সদর ও আশপাশের জালিয়ারপাড়া, নাজিরপুর, বড় হাবিরপাড়া, ছোট হাবিরপাড়া, মৌলভীপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানান, ইয়াবার গডফাদাররা সম্প্রতি এলাকায় চলে এসেছেন। এখন আসছে ইয়াবার বড় বড় চালান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের দহরম-মহরম সম্পর্ক। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা থাকে। অনেকে শুধু নামেই রাজনীতিবিদ, তাদের মূল ব্যবসা ইয়াবা। অঢেল ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় সাঁড়াশি অভিযানেও ইয়াবার গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকেছিল। এখন এলাকায় এসেছে।
ইয়াবার ৫৪ গডফাদার যারা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স সর্বশেষ ৫৪ গডফাদারের নাম প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ২৩ জন আত্মসমর্পণ করেছে। সাত জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। বাকি ২৪ জন গডফাদার বহাল তবিয়তে আছে। আত্মসমর্পণকারী ২৩ জন কক্সবাজার জেলখানায় আছে। তারা সেখানে বসে আত্মীয়স্বজন ও তাদের নিয়োজিত মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। জেলখানায় বসেই নিরাপদে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর যেসব মাদক ব্যবসায়ী আত্মগোপনে ছিল, তারা এখন এলাকায় ফিরে এসেছে। আত্মসমর্পণকারী ইয়াবার গডফাদাররা হলো—মো. আব্দুস শুক্কুর, আব্দুল আমিন, সাহেদুর রহমান নিপু, মো. সফিক, মো. ফয়সাল, শাহেদ কামাল, কামরুল হাসান রাসেল, মারুফ বিন খলিল ওরফে বাবু, মো. নুরুল হুদা, দিদার মিয়া, এনামুল হক মেম্বর, মো. একরাম হোসেন, ছৈয়দ হোসেন মেম্বর, মৌলভী বশির ওরফে ডাইলা, শাহ আলম, আব্দুর রহমান, মোজাম্মেল হক, জোবায়ের হোসেন, নুরুল বশর ওরফে নুসরাত কাউন্সিলর, মো. শাহ মালু, মো. ইউনুছ, সৈয়দ হোসেন ছইতু ও হাসান আব্দুল্লাহ।
নিহত সাত জন হলো—সাইফুল করিম, আখতার কামাল, শামসুল আলম মার্কিন, হাবিবুল্লাহ হাবিব, জিয়াউর রহমান, ইউসুফ জালাল বাহাদুর ও মোশতাক আহমেদ ওরফে মশু।
বহালতবিয়তে যারা আছে তারা হলো—নুরুল আলম, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ, মৌলভী আজিজ উদ্দিন, উপজেলা কমিউনিটি পুলিশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম, সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর দুই পুত্র মামুন মোর্শেন ও রাশেদ, সাইফুল ইসলাম, মোশতাক আহমেদ, নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আমিন, শাহজাহান, মৌলভী বোরহান, ডাকাত আব্দুল হাকিম, মো. আব্দুল্লাহ, জাফর আলম, মো. কাশেম, আব্দুর রহমান, হেলাল আহমেদ, নুরুল আফসার, শাহজালাল, মৌলভী রফিক উদ্দিন ও মৌলভী মজিবর রহমান। /ইত্তেফাক
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-