বাবুল আকতারের হাত ধরে ক্রসফায়ারে পারদর্শী হয়ে উঠে ইন্সপেক্টর লিয়াকত!

মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোঃ রাশেদ খাঁন হত্যা মামলার প্রধান আসামী টেকনাফ বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী ছিলেন পুলিশের সোয়াত ও এন্টি টেরিরিজম টিমের সদস্য। এই টিমে যোগদানের পর থেকেই গুলি করে মানুষ হত্যা তার নেশা ও পেশায় পরিণত হয়। মানুষের গায়ে গুলি করতে সে দ্বিধাবোধ করত না। সে বেশ কয়েকটি জঙ্গি অভিযানে অংশগ্রহণ করে অনেক কথিত জঙ্গি সদস্যকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে লিয়াকত।

এক বছর আগে টেকনাফ থানায় যোগদানের পর ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে মাদক কারবারি নির্মূল অভিযানের নামে ওসি প্রদীপের সাথে ১৬১টি বন্দুকযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন লিয়াকত আলী। সেখানে ছোটখাট ইয়াবা কারবারিসহ কতিপয় নিরীহ মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধে গুলি চালাতেন লিয়াকত আলী। গত জানুয়ারী থেকে টেকনাফ বাহারছরা শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে আইসির দায়িত্ব পান ওসি প্রদীপের এই পুলিশ পরির্দশক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর এলাকায় এক জঙ্গি অভিযানে ১৫ বছরের ১ কিশোর সহ ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে হাত পাকা করেন লিয়াকত আলী। এছাড়াও ২০১৬ সালে সীতাকুণ্ডে এক কথিত জঙ্গি অভিযানে আরো ২ জনকে গুলি করে হত্যা করে লিয়াকত আলী।

তৎকালীন সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের কিলিং টিমের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে লিয়াকত আলী কাজ করতো বলে জানা গেছে। মূলত বাবুল আকতারের হাত ধরে ক্রসফায়ারের নামে মানুষকে গুলি করা হত্যায় পারদর্শী হয়ে উঠে লিয়াকত। জঙ্গি সম্পৃক্তার অভিযোগে বাবুল আকতার নিজেও অসংখ্য মানুষকে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করেছিলেন। পরে আততীয়রা তার স্ত্রীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। স্ত্রী হত্যার পিছনে বাবুল আকতার নিজেই জড়িত বলে অভিযোগ উঠার পর পুলিশের চাকুরী ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।

১০ বছর আগে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া লিয়াকত আলী গত বছরের শেষের দিকে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান। তিনি সোয়াত টিমের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য ছিলেন। সর্বশেষ কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। পদোন্নতির পর কক্সবাজার জেলা পুলিশে গিয়ে যোগদান করেন। গত ১৮ জানুয়ারি বাহারছড়া পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে যোগদান করেন।

এরপর থেকে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিশ্বস্থ সহযোগী ছিল টেকনাফ শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের আইসি লিয়াকত আলী। তারা দুইজনেই টেকনাফ থানা এলাকায় সাজানো ক্রসফায়ারের নামে ১৪৪ টি ক্রসফায়ারে ১৬১ জন মানুষ হত্যার মিশন সফল করেন পুুলিশ পরির্দশক লিয়াকত আলী।

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় পর সারাদেশের ন্যায় পটিয়ায়ও বইছে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে গাড়ি তল্লাশির নামে পরিকল্পিত ভাবে মেজর সিনহাকে গুলি করেন পুলিশ পরির্দশক লিয়াকত আলী। তার গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব সামারোপাড়া। সে ঐ এলাকার মৃত সাহাব মিয়ার ছোট ছেলে ।

পরির্দশক লিয়াকতের পটিয়ার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সেমিপাকা টিনশেড ঘরটি তার পৈত্রিক বসত ঘর। তার বাবা বাড়িটি আজ হতে আরো বিশ বছর আগে তৈরি করেন। গতকাল বিকেলে লিয়াকতের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার ইমিডিয়েট বড়ভাই হায়দার আলী সঙ্গে ।

তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই ভালো নাকি খারাপ সেটা তার ডিপার্টমেন্ট ভালোভাবেই জানে। যেহেতু একটা ঘটনা ঘটেগেছে, তাই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি দেখবে। তিনি আফসোস করে বলেন, কিভাবে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছি না।

আরো জানা যায়, পুলিশ পরির্দশক লিয়াকত আলীরা ছয় ভাই এক বোনের মধ্যে লিয়াকত সবার ছোট। তাদের পরিবারের ভাই বোন সবাই উচ্চ শিক্ষিত।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পুলিশ পরির্দশক লিয়াকত আলী পটিয়ার হাবিলাসদ্বীপ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর হুলাইন ছালেহ নূর ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে অনার্সে ভর্তি হন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে। সেখান থেকে অনার্স শেষে এমবিএ করেন নগরীর প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে।

বিবাহিত জীবনে লিয়াকত দুই বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রী ডির্ভোস দিয়ে চলে যাওয়ার পর পাশ্ববর্তী উপজেলা বোয়ালখালী হতে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার আড়াই বছরের এক ছেলে সন্তান রয়েছে।

সে পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের পূর্ব হুলাইন গ্রামের মৃত সাহাব মিয়ার ৬ পুত্রের মধ্যে লিয়াকত আলী সর্বকনিষ্ঠ। ২০১০ সালে সে সরাসরি পুলিশের উপ-পরিদর্শক পদে চাকুরী পায়। সেসময় পটিয়ার সাংসদ ও বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর সুপারিশে তার চাকুরী নিশ্চিত হয়। নিজেকে ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয় দিয়ে পটিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যন মাজেদা বেগম শিরুুু’র অনুরোধে এমপি শামসুল হক তার পক্ষে সুপারিশ করেন।

৩১ জুলাই রাতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খানকে টেকনাফ শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের আইসি লিয়াকত ওসি প্রদীপের নির্দেশে গুলি করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের পরে মেজর সিনহার বোনের করা একটি হত্যা মামলায় সাবেক ওসি প্রদীপ ও আইসি লিয়াকত আলীসহ ৭ আসামী এখন কক্সবাজার কারাগারে। মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‍্যাব তাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে।

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারাদেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করে সরকার। মাদক বিরোধী এই অভিযানকে পুঁজি করেই টেকনাফের বহিস্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার ও লিয়াকত সহ তার সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে শত শত নয় হাজার হাজার কোটি টাকা। হত্যা করে দেড় শতাধিক নিরীহ মানুষ। আর ওই টাকায় ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় লিয়াকত আলী ১ নম্বর আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়া সারাদেশের মানুষের মতো তার এলাকা পটিয়ার জনসাধারণ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে এবং তার উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেছেন এলাকার বাসিন্দারা। এদিকে দিন যত যাচ্ছে ততই ওসি প্রদীপের মতো পরির্দশক লিয়াকতের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে আসছে।

নগরীর পতেঙ্গা এলাকার ব্যাবসায়ী এস এম জসিম উদ্দিন জানান মেজর অবঃ সিনহার খুনী লিয়াকত আলী আমার ব্যাবসায়িক প্রতিপক্ষের দায়ের করা মামলার আই ও থাকা অবস্থায় মামলার সঠিক রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ৫ লাখ টাকা ঘুষ ছেয়েছিলেন । আমি টাকা দিতে অস্বীকার করলে, আসামীদের সাথে কন্ট্রাক্ট করে আসামী শাহাবুদ্দিন পিতা মৃত খলিলুর রহমান বাড়ি জামাল কান্দি থানা দাউদকান্দি জিলা কুমিল্লা এর খালাতো বোনকে বাদী সাজিয়ে নারী নির্যাতনের মামলা দিয়ে বিগত ১৪/৬/১৪ সালে চট্টগ্রাম মহানগর ডিবি কার্যালয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে আসামীদের বানানো আপোষ নামায় স্বাক্ষর দিতে চাপ দেয়।আমি স্বাক্ষর না করায় উক্ত নারী নির্যাতন মামলায় আমি জামিনে গিয়ে ১৮/৫/১৪ ইং সংস্লিস্ট থানায় রিকল জমা দেওয়া সত্বেও ৭/৬/১৪ ইং অবৈধ ওয়ারেন্ট রিকুইজিশন দিয়ে পতেংগা থানায় পাঠায়। ওয়ারেন্ট রিকুইজিশন টি ভুয়া হওয়ায় ওসি পতেঙ্গ আমাকে ছেড়ে দিলেও এসআই লিয়াকত ও উক্ত মামলার আসামিরা আমাকে ডিবির গাড়ীতে তুলে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে ২ লাখ টাকা আদায় করে এবং সদরঘাট থানায় নিয়ে আমার আসামীকে বাদী বানিয়ে ৩৮৬/৩৮০/৫০৬ ধারায় সদরঘাট থানার মামলা নং ১৯(৬)১৪ দিয়ে আটক করে সারারাত অমানুষিক নির্যাতন এমনকি ইলেক্ট্রিক সক দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে। জেল হাজতে দিয়ে আমার দায়েরী মামলা নং সি আর ৩৯৪/১৩ ধারা ৩৮০/৪২৭/৫০৬/৩৪ দঃবিঃ মামলার ঘটনা মিথ্যা বলে বিজ্ঞ আদালতে প্রতিবেদন দেয়। আমি কারামুক্ত হয়ে না-রাজি দিলে সি, আই,ডি মামলা তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন দিলে আদালত আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। অপরদিকে অবৈধ ভাবে লাভবান হয়ে রি-কল গোপন করে ওয়ারেন্ট রিকুইজিশন পাঠানোর দায়ে দাউদকান্দি থানার এসআই নজরুল ও এসআই হান্নানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা নং কুমিল্লা ২৬/১৫ এবং ২৭/১৫ দায়ের হয়েছিল এবং উক্ত নারী নির্যাতন মামলাটি বিজ্ঞ আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এভাবে লিয়াকত আমার নামে ১৩ টি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন চট্টগ্রাম সহ আরো কয়েক জেলায়। তাদের মধ্যে আমি ১০ টি মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছি। বাকী ৩ টি মামলায় ও খালাস পেয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।

এদিকে সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে কারাগারে আছেন পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। অথচ ‘অ্যাকটিভ’ দেখাচ্ছে তার ফেসবুক আইডি। মঙ্গলবার রাতেও ফেসবুক মেসেঞ্জারে তার আইডি অনলাইন পাওয়া যায়। এমনকি গত ৬ আগস্ট আদালত থেকে কারাগারে যাওয়ার দিনও তার আইডির ‘প্রোফাইল পিকচার’ পরিবর্তন করা হয়েছে। /পাঠক নিউজ

আরও খবর