সিনহা রাশেদ হত্যা মামলা: গুলির ঘটনা কি পরিকল্পিত

সমকাল ◑

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার ঘটনায় পুলিশের করা মামলার তিন সাক্ষীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজারের বাহারছড়া মারিশবুনিয়া থে?কে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া এলাকার জালাল আহম্মদের ছেলে আয়াছ উদ্দিন, নজির আহমদের ছেলে নিজাম উদ্দিন ও নাজিম উদ্দিনের ছেলে নুরুল আমিন। ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা পুলিশের মামলার সাক্ষী। সিনহা হত্যার সঙ্গে তাদের সংশ্নিষ্টতার সূত্র পাওয়া যাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও তথ্য নেওয়া হবে।

এদিকে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে নুরুল আমিনের মা খালেদা বেগম বাদী হয়ে গতকাল টেকনাফ থানায় অপহরণ মামলা করেন।

টেকনাফ থানার নবনিযুক্ত ওসি আবুল ফয়সাল জানান, পুলিশের মামলায় যে তিনজনকে সাক্ষী করা হয়েছিল, গতকাল সকাল ৯টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে তাদের জবানবন্দি দেওয়ার কথা ছিল। ওই সংক্রান্ত একটি চিঠি নিয়ে তাদের গ্রামে যায় পুলিশ। কিন্তু সেখানে কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ সময় নুরুল আমিনের ঘর তালাবদ্ধ ছিল।

ওসি আরও বলেন, আমি আরেকটি টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের না পাওয়ার বিষয়টি যাচাই করি। তখন তাদের স্বজনরা পুলিশকে জানান, সাদা পোশাকে কে বা কারা তিনজনকে ধরে নিয়ে গেছে। এটা জানার পর পুলিশ স্বজনদের এ বিষয়ে মামলা করার পরামর্শ দেয়। তারপর সকালে নুরুল আমিনের মা খালেদা বেগম বাদী হয়ে একটি অপহরণ মামলা করেন। পরে দুপুরে জানতে পারি ওই তিনজনকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে।

পুলিশের মামলায় বলা হয়েছিল, ‘বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র এলাকায় নিয়মিত টহল চলাকালে ঘটনার দিন রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে মারিশবুনিয়া সাকিনের কমিউনিটি পুলিশের সদস্য নুরুল আমিন (২১) ফোনে লিয়াকতকে জানায়, কয়েকজন ডাকাত পাহাড়ে ছোট ছোট টর্চলাইট জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে। পরে নুরুল আমিন বিষয়টি নিজাম উদ্দিনকে জানান। এরপর নিজাম উদ্দিন স্থানীয় মারিশবুনিয়া নতুন মসজিদের মাইকের মাধ্যমে ঘোষণা দেন- ডাকাত নেমে আসছে। এলাকার সবাইকে একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান তিনি। কিছু সময় পর পাহাড় থেকে দুই ব্যক্তি নেমে এলে গ্রামের ২০-৩০ জন লোক একত্রিত হয়। মাঈন উদ্দিন নামে এলাকার একজন টর্চলাইট জ্বালিয়ে তাদের গায়ে সেনাবাহিনীর পোশাকসদৃশ বস্তু দেখতে পান। ওই সময় এক ব্যক্তি অস্ত্র উঁচিয়ে এলাকাবাসীকে গালি দেয়। পরে সিলভার রঙের প্রাইভেটকারে তারা মেরিন ড্রাইভের দিকে চলে যায়। এরপর নুরুল আমিন মোবাইল ফোনে বিষয়টি পরিদর্শক লিয়াকতকে অবহিত করে।’

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, পাহাড় থেকে ‘ডাকাত সদস্য’ নেমে আসা, মসজিদে মাইকিং, ফোনে লিয়াকতকে জানানো এসব পূর্বপরিকল্পনার অংশ কিনা তা যাচাই করা হচ্ছে। আসলে কী ঘটেছিল তা নিশ্চিত করতে পুলিশের মামলার তিন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। এরই মধ্যে এমন কিছু আলামত পাওয়া যাচ্ছে যাতে সাক্ষীদের যথেষ্ট সন্দেহজনক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তদন্তে এটা প্রমাণিত হলে তারা সাক্ষী থেকে আসামি হতে পারেন। আর পুলিশের মামলায় বাহারছড়া পুলিশ কেন্দ্রের নিয়মিত চেকপোস্টের কথা বলে আসলে লিয়াকত গুলি করেছিল এপিবিএনের চেকপোস্টে গিয়ে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, সিনহা হত্যা সম্পর্কে পুলিশের পক্ষ থেকে এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে চেকপোস্টে সিনহার গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে সিনহা বাধা দেন। এই সময়ে পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর সঙ্গে মেজর সিনহার তর্কবিতর্ক হয়। এর একপর্যায়ে মেজর সিনহা তার কোমরে থাকা অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে উদ্যত হলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি করে। এতে সিনহার প্রাণহানি ঘটেছে। পুলিশের এই দাবি নিয়ে প্রথম থেকেই সন্দেহ দেখা দেয়। গাড়িতে সিনহার সঙ্গী স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বরাত দিয়ে র‌্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, সিনহা গাড়ি থেকে নামার সময় তার কাছে কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি। অস্ত্রটি গাড়িতেই ছিল।

আরও জানা গেছে, ঘটনার পরপরই মালখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সদস্যকে ফোন করেছিল লিয়াকত। সাজানো মামলায় কোনো আলামত দেখানোর জন্য মালখানা থেকে কিছু নিয়েছেন কিনা তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। সিনহা হত্যা পূর্বপরিকল্পিত ছিল, না তাৎক্ষণিক তর্কবিতর্কের জের ধরে ঘটেছে, তা জানার চেষ্টা করছে তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব।

কক্সবাজারে র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ জানিয়েছেন, আমরা ঘটনার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। মেজর সিনহার সঙ্গে কোনো সময়ে কারও বিরোধ ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিজিবিতে কাজ করার সময় কারও সঙ্গে সিনহার বিরোধ তৈরি হয়েছিল কিনা, তাও দেখা হবে। এই হত্যাকাণ্ডে পুলিশের বাইরে কেউ জড়িত কিনা, তাও তদন্তে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

র‌্যাব কর্মকর্তা আজিম আহমেদ বলেন, মামলার আসামিদের রিমান্ডে নেওয়ার জন্য এখনও উদ্যোগ নেয়নি র‌্যাব। আজ বুধবার আদালতে চারজনের রিমান্ড আবেদনের বিষয়ে শুনানির দিন রয়েছে। যাদের রবি এবং সোমবার জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এই চারজনকে রিমান্ডের জন্য আবেদন করা হয়েছে। রিমান্ড মঞ্জুর হলে আগে তাদের দিয়ে র‌্যাব জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবে। এরপর লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ ও নন্দদুলাল রক্ষিতকে রিমান্ডে নেওয়া হবে। এই তিনজনের আগেই সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের বাহারছড়া চেকপোস্টে তল্লাশির সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এরপর ৩ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ঘটনার তদন্তে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যরা ইতোমধ্যে সিফাত, শিপ্রাসহ অন্য সাক্ষী এবং অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ ছাড়া এই ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সাক্ষ্যও নিয়েছে কমিটি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

তিন সাক্ষীর ফোনালাপ :তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ঘটনার আগে পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকতের সঙ্গে তিন সাক্ষীর ফোনালাপের কল রেকর্ড পাওয়া গেছে। তাদের একজনের সঙ্গে ১০ থেকে ১২ বার কথা বলেছেন লিয়াকত। কে ও কী কারণে এতবার কথা হয়েছে, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।

আরও খবর