কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত বলে জানিয়েছে সেনাসদর।
একইসঙ্গে ঘটনাটির যথাযথ তদন্তের প্রয়োজনে উভয় বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি যৌথ তদন্ত দল গঠন করাসহ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ আইনের আওতায় আনা যেতে পারে বলে সেনাসদর এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে।
অন্যদিকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহতের ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শনিবার সন্ধ্যায় এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব শাহে এলিদ মাইনুল আমিন স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় বলা হয়, তিন সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. শাজাহান আলি।
অন্য দুই সদস্য হলেন কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার মনোনীত একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কক্সবাজারের এরিয়া কমান্ডারের একজন প্রতিনিধি। কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের ভেতরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, কমিটি ঘটনার বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে ঘটনার কারণ, উৎস অনুসন্ধান করবে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় ইত্যাদি সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণপূর্বক সুস্পষ্ট মতামত দেবে।
অন্যদিকে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর শনিবার বিকালে মেরিন ড্রাইভ রোডের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ি এলাকার ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর একটি তদন্ত দল পরিদর্শনে গিয়েছে।
ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত: সেনাসদর
এ ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত জানিয়ে সেনাসদর বলছে: মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থামিয়ে তাদের পরিচয় দিলে প্রথমে তাদের যাওয়ার জন্য সংকেত দিলেও এসআই লিয়াকত তাদের পুনরায় থামায় এবং তাদের দিকে পিস্তল লক্ষ্য করে গাড়ি থেকে নামতে বলে। মেজর সিনহা হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামার পরপরই এসআই লিয়াকত তাকে লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড গুলি করে। জানা যায় যে, এসআই লিয়াকত কোনরূপ কথাবার্তা না বলেই গাড়ি থেকে নামার পরপরই মেজর সিনহাকে করে লক্ষ্য গুলি করে।
এক বিজ্ঞপ্তিতে সেনাসদর জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশ দু’টি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সাথে দেশমাতৃকার সেবায় কাজ করে আসছে। পেশাদার এ দুটি বাহিনীর মধ্যকার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও কর্মপরিবশে অত্যন্ত চমৎকার। কক্সবাজার পুলিশ দ্বারা বর্ণিত অপ্রীতিকর ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত।
ঘটনার বিবরণী বিশ্লেষণ করে সেনাসদর বলছে: ‘‘প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী স্যুটিংয়ের জন্য মেজর (অব.) সিনহা সামরিক পোশাক পরিধান করেছেন, যা পরিধান করার আগে স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা উচিত ছিল।
একজন সামরিক পোশাকধারী কর্মকর্তা পরিচয় প্রদানের পরও কোনো জিজ্ঞাসাবাদ ব্যতিত এসআই লিয়াকত কর্তৃক গুলিবর্ষণ করার ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। একইসাথে একজন ব্যক্তি হাত তুলে গাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তাকে আটক না করে সরাসরি গুলি করা সম্পূর্ণ আইন বহির্ভুত।
পুলিশ কর্তৃক এএসইউ এর মাঠকর্মী পরিচয় জানার পরেও তার পরিচয় ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়াটা সমীচিন হয়নি।’’
সেনাসদর জানায়: ‘‘সামরিক পোশাক পরিহিত থাকা অবস্থায় মেজর (অব.) গুলি করার পরই তার বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্ট অভিযোগ উত্থাপনের ঘটনাটিকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা বলে অনুমেয়।
ঘটনাটির যথাযথ তদন্তের প্রয়োজনে উভয় বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি যৌথ তদন্ত দল গঠন করাসহ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ আইনের আওতায় আনা যেতে পারে।
করোনা মহামারির এই কঠিন সময়ে সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশ সম্মুখ সারিতে থেকে দেশের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে দুই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যে কোন ধরণের ভুল বুঝাবুঝি এড়ানোর লক্ষ্যে যৌথ তদন্ত কার্যক্রম অনতিবিলম্বে শুরু করা এবং তা সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহতি করা উচিৎ।’’
গতকাল শুক্রবার রাত ৯টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়ায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে সিনহা রাশেদ খান নিহত হন।
এ ব্যাপারে জেলা পুলিশ জানিয়েছে: সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে অপর একজন সঙ্গীসহ টেকনাফ থেকে কক্সবাজার আসছিলেন। মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন। এই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে সেনা কর্মকর্তা তার কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান গুরুতর আহত হন। তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। শনিবার সকালে নিহতের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন জানিয়েছেন: শামলাপুরের লোকজন ওই গাড়ির আরোহীদের ডাকাত সন্দেহ করে পুলিশকে খবর দেয়। এই সময়ে পুলিশ চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু গাড়ির আরোহী একজন তার পিস্তল বের করে পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি মারা যান।
মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা রাশেদ খান ২০১৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন উপসচিব মো. এরশাদ খানের ছেলে। তিনি রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে ২০০২ সালে এইচএসসি পাস করেন। তিনি গত ৩ জুলাই ঢাকা থেকে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের তিনজন ছাত্রছাত্রীসহ একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য একটি ট্রাভেল ভিডিও তৈরি করতে কক্সবাজার আসেন। প্রায় এক মাস যাবত তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে শুটিং করেন।
অন্যদিকে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন তার রাজউক কলেজের বন্ধুরা। তারা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
সূত্র : চ্যানেল আই অনলাইন
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-