উখিয়া-টেকনাফে কমছে না ইয়াবা পাচার ও ব্যবসা

রফিকুল ইসলাম :
মাদকের সর্বনাশা বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ছে। তরুণ প্রজন্মকে এর অভিশাপ থেকে রক্ষায় ২০১৮ সালের ৪ মে দেশজুড়ে বিশেষ অভিযান শুরু করে র‌্যাব।

এরপর বিজিবি, পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাও মাদকবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। অভিযানে গতকাল টেকনাফে বিজিবির সাথে কথিত বন্দুক যুদ্ধে দুই রোহিঙ্গা ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহতসহ তিন জেলায় ৫ জন নিহত হয়েছে।

কিন্তু গত প্রায় আড়াই বছরে মাদক কারবারের ব্যাপকতা কমেনি বরং বেড়েই চলছে, বিস্তৃতি ঘটছে মাদক ব্যবহার, পাচার, মজুূদ, বাজারজাত, অবৈধ লেনদেনের বহুমাত্রিক ডালপালা। কার্যত মিয়ানমার তৈরি ইয়াবা পাচার ও ব্যবসা এখন আর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে সীমাবদ্ধ নেই। এর বিস্তৃতি ঘটেছে দেশের দক্ষিণ -পশ্চিম উপক‚লীয় এলাকাসহ ভারত সীমান্তে।

আশা করা হচ্ছিল করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে ইয়াবাসহ অনান্য মাদক পাচার ও ব্যবসা অনেকটা কমে আসবে। কিন্তু অতীতের তুলনায় তা বেড়েছে কয়েকগুণ।

সর্বশেষ শনিবার (২৫ জুলাই) গতরাতে টেকনাফের মোছনী খাল দিয়ে মিয়ানমার থেকে পাচার করে আনার সময় বিজিবি উদ্ধার করেছে ২ লক্ষ ১০ হাজার পিস ইয়াবা। এতে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে উখিয়ার বালুখালী -১ ক্যাম্পের দুই রোহিঙ্গা।

আগেরদিন শুক্রবার টেকনাফ পুলিশ উদ্ধার করে ৪০ হাজার ইয়াবা। ঐদিন বন্দুক যুদ্ধে উখিয়ার বখতিয়ার মেম্বারসহ এক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী মাদক বিরোধী অভিযানে শনিবার পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র?্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৮২ জন নিহত হন। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ৯৫ জন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬৯ জন, বিজিবির সঙ্গে ৬০ জন ও র?্যাবের সঙ্গে ৫১ জন। কিন্তু তবুও কমেনি ইয়াবা পাচার ও ব্যবসা।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের সর্বশেষ তালিকায়, কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১ হাজার ২৫০ জন। এর মধ্যে শুধু টেকনাফে রয়েছেন ৯১২ জন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবা তালিকায় কক্সবাজারের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি আছেন ৭৩ জন। দেশব্যাপী এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তিন হাজারের মতো ব্যবসায়ী, যাঁদের সাড়ে তিনশ’র মতো গডফাদার রয়েছে। এসব ব্যবসায়ী ও গডফাদার সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর তালিকাভুক্ত। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে চলা এত বড় অভিযানেও অনেকেই ধরা পড়েনি।

এখনো বড় বড় ইয়াবার চালান যে আসছে, তা স্বীকার করেই কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, সেটা রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে আসছে। তাঁর দাবি, টেকনাফে আগে যাঁরা ইয়াবা ব্যবসা করতেন, তাঁদের ৯০ শতাংশ এখন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। দুই দফায় ১২৩ জন ইয়াবা কারবারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।

ইয়াবা কারবারীর মধ্যে জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতা আছেন। তারাই মূলত নেপথ্যে মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। আর মাদক চক্রের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য রয়েছেন। মুলত অনেকটা চিহ্নিত এসব ‘হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল’দের শক্তিশালী দুষ্টু চক্রের বৃত্ত ভাঙা না গেলে মাদকবিরোধী অভিযানের সুফল পাওয়া কঠিন।

পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রæ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় চালান আনা হচ্ছে। উখিয়ার ডেইলপাড়া, করইবনিয়া, পূর্ব ডিগলিয়া, হাতিমুরা, ভালুকিয়া, পাতাবাড়ী রহমতের বিল, আনজুমানপাড়া, বালুখালী মৎস্য ঘের ও কাটাপাহাড় দিয়েও ইয়াবা আসছে। চিংড়ি প্রজেক্টের বহু মালিক-শ্রমিক এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বড় চালানের আরেকটি অংশ ঢুকছে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত ও বান্দরবান সদর এলাকা হয়ে। এসব চালানের টার্নিং পয়েন্ট ও  মজুদাগার হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে।

ইয়াবা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে অবৈধ অর্থনৈতিক সিন্ডিকেট। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা কারবার প্রায় পুরোপুরি হুন্ডি নির্ভর। যারা ইয়াবা কারবারের নেপথ্যে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগ করছে, তারা এখনও রয়েছে ধরাছোয়ার বাইরে। হুন্ডির মাধ্যমে ইয়াবা বিক্রির অর্থ সৌদি আরব বা দুবাই হয়ে চলে যায় সিঙ্গাপুরে। সেখান থেকে তা চলে যায় মিয়ানমারের পার্টির কাছে। ক্যাম্প অভ্যন্তর ও আশপাশে গজে উঠা স্বর্ণের দোকানগুলোর মাধ্যমেও চলছে স্বর্ণ ও মুদ্রা পাচার।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এড. আয়াছুর রহমান বলেন, মিয়ানমার এখন বাকিতে ইয়াবা দিচ্ছে। সেই বাকির ইয়াবা দিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ইয়াবার ডিপোতে পরিণত হয়েছে। উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রীক গড়ে উঠা একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রæপের নিয়ন্ত্রণে চলছে ইয়াবা ব্যবসা ও পাচার। তাদের সাথে যুক্ত আছে ক্যাম্প ও সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার পুরনো ইয়াবা পাচারকারী ও ব্যবসায়ীরা।

কক্সবাজার ৩৪ বর্ডার গার্ড ব্যাটলিয়ান (বিজিবি) এর অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ বলেন, গত ২/৩ মাসে  অতীতের চেয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার বেড়েছে। তিনি বলেন, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সময়ে বিজিবি একাধিক অভিযান চালিয়ে ১৫ লাখের বেশি ইয়াবা বড়িসহ ৯৯ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ১২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) বার্ষিক প্রতিবেদেেন উঠে এসেছে ইয়াবা আসক্তির ভয়াবহ তথ্য। গত ৭ বছরের ব্যবধানে সারা দেশে ইয়াবা আসক্তি বেড়েছে ৫.৭৭ ভাগ থেকে ৪২.৩ ভাগ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে এ তথ্য জানা যায়। উখিয়া, টেকনাফসহ পুরো কক্সবাজার জেলায় ইয়াবা ব্যবসা ও পাচারের সাথে আশংকাজনক হারে বাড়ছে সেবনকারীর সংখ্যা।

র‌্যাব-১৫ অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, ‘যতই দিন যাচ্ছে, রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ক্যাম্পে একাধিক সশস্ত্র রোহিঙ্গা ডাকাত দল সক্রিয় রয়েছে। এতে অভিযানের সময় আমাদের সদস্যরাও গুলিবিদ্ধ হচ্ছে।’ তিনি বলেন, বৈশ্বিক করোনা মহামারীতেও এদের কোন পরিবর্তন নেই। করোনার আগের ন্যায় রোহিঙ্গারা এখনও সমানে অপরাধ চালাচ্ছে।

আরও খবর