থানায় যেভাবে রাত কাটে সাবরিনার

এম.জমিন ◑

জেকেজি হেল্‌থ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা শারমিন হোসাইন ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী বিষয়ে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চমকপ্রদ তথ্য। তদন্তে এই দম্পতির প্রতারণার চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়ে খোদ পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টরাই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছেন। পুলিশ জানিয়েছে, সাবরিনা ও আরিফ দম্পতির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জেকেজি ট্রেড লাইসেন্স হওয়ার আগেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে করোনার বুথ স্থাপন করে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে আসে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের ১৬ই জুন সিটি করপোরেশন থেকে জেকেজি’র ট্রেড লাইসেন্স নেয়া হয়। অথচ চলতি বছরের ৬ই এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) স্বাক্ষরিত চিঠিতে জেকেজি তিতুমীর কলেজে বুথ স্থাপন করে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি পায়। এছাড়া জেকেজি’র চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা শারমিন হোসাইন বরাবরই দাবি করে আসছিলেন জেকেজি হলো ব্যক্তি মালিকানাধীন ওভাল গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু পুলিশি তদন্তে এখনও ওভাল গ্রুপের সঙ্গে জেকেজি’র কোনো সংশ্লিষ্টতা মিলেনি। কারণ জয়েন্ট স্টক থেকে পুলিশ ওভাল গ্রুপের যে সকল কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে সেগুলোতে এই গ্রুপের সহযোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নাম ও কাগজপত্র পাওয়া গেলেও জেকেজি হেল্‌থ কেয়ারের কোনো নাম বা কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।

এদিকে, জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান সাবরিনা চৌধুরীকে তিনদিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। প্রতারণা মামলায় তেজগাঁও থানার তদন্ত কর্মকর্তা গতকাল তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (সিএমএম) হাজির করে চারদিনের রিমান্ড আবেদন করেন। পরে আদালত তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জেকেজি হেল্‌থ কেয়ারের মাধ্যমে ডা. সাবরিনা চৌধুরী স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতেন। টেলিভিশনের বিভিন্ন টকশো এবং বাইরের আরো কিছু অনুষ্ঠানে তিনি নিজেকে জেকেজি’র হয়ে পরিচয় দিতেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারি সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরে এই প্রতিষ্ঠানের কোনো রেজিস্ট্রেশন ছিল না। শুধু ১৬ই জুন সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত একটি ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া গেছে। তবে এই লাইসেন্সটিতে সাবরিনা ও আরিফের কোনো নাম নেই। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ওই জেকেজি’র লাইসেন্সটি এই প্রতিষ্ঠানের কো-অর্ডিনেটর আ স ম সাঈদ চৌধুরীর স্ত্রী জেবুন্নেসা রীমার নামে। প্রতারণা মামলায় আ স ম সাঈদ চৌধুরীও গ্রেপ্তার আছেন। ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের আর কোনো কাগজপত্র নেই। নাম প্রকাশ না করে একজন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সম্পূর্ণ অবৈধভাবে জেকেজি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রভাব খাটিয়ে কাজ ভাগিয়ে এনেছে। এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর কাজ তারা কোনো রকম বৈধতা ছাড়া কীভাবে নিয়ে এলো এ নিয়ে তদন্ত চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আরিফ ও সাবরিনা দম্পতি করোনার নমুনা সংগ্রহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ভাগিয়ে নিতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে ডা. সাবরিনা সিনিয়র চিকিৎসক হওয়াতে সরকার দলীয় চিকিৎসক নেতাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। এছাড়া অনেকের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল। সাবরিনা সেই সুযোগেই নিজের কাজ আদায় করে নিতেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সর্বত্রই তার বিচরণ ছিল। এতে করে খুব সহজেই বৈধ কোনো কাগজপত্র ছাড়াই করোনার নমুনা সংগ্রহের অনুমতি পায়। এছাড়া কাগজে-কলমে একটি বুথের অনুমতি থাকলেও তারা প্রভার খাটিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে অবগত না করে ৪০টির মতো অবৈধ বুথ স্থাপন করে। বুথ, হটলাইন ও বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালিয়ে তারা ২৭ হাজার মানুষের নমুনা সংগ্রহ করে। বিনামূল্য নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে তারা প্রতি রোগীর কাছ থেকে ৫ হাজার ও বিদেশি নাগরিক হতে ১০০ ডলার করে নিয়েছে। এভাবে তিন মাসের মাথায় তারা ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সূত্র বলছে, অবৈধভাবে আয় করা এসব টাকা শুধু সাবরিনা ও আরিফ দম্পতি নিজে ভোগ করেনি। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে, স্বাস্থ্য সেক্টরের কর্মকর্তা, চিকিৎসক নেতাদের পকেটে গেছে। কার কার পকেটে এসব টাকা গেছে পুলিশ এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে।

থানায় যেভাবে কেটেছে সাবরিনার: ডিএমপি’র তেজগাঁও ডিভিশনের এক কর্মকর্তা জানান, জেকেজি কেলেঙ্কারি নিয়ে কথা বলার জন্য জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের রেজিস্ট্রার চিকিৎসক ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে রোববার ফোন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি রোববারে আসতে অপারগতা জানান। পরে তাকে মাত্র আধাঘণ্টা কথা বলে ছেড়ে দেয়া হবে বলে জানানো হয়। পরে তিনি তেজগাঁও ডিভিশনের উপ-কমিশনার (ডিসি) কার্যালয়ে আসেন। ডিসি অফিসের অভ্যর্থনা কক্ষে বসিয়ে তাকে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সাবরিনা চৌধুরী দেখতে পান টেলিভিশনে স্ক্রলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তখন তিনি উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন- টিভিতে স্ক্রল দিচ্ছে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর তাকে নিয়ে পাশেই ডিসি’র কক্ষে নেয়া হয়। সেখানে গিয়ে তিনি ডিসিকে বলেন, আমাকে কি আপনারা গ্রেপ্তার করেছেন। তখন ডিসি তাকে বলেন, গ্রেপ্তার করা হয়নি। এখানে সাংবাদিকরা চলে আসছে তাই নিরিবিলি কথা বলার জন্য আপনাকে তেজগাঁও থানায় নেয়া হবে। এ সময় ডিসি তাকে বেশকিছু প্রশ্ন করেন। কিন্তু তিনি কোনো প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পারেননি। সাবরিনা যখন বুঝতে পারেন তিনি সত্যিই গ্রেপ্তার হয়েছেন তখন তিনি কান্নাকাটি শুরু করেন। জেকেজি বা টেস্ট প্রতারণার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন। পরে তাকে পুলিশ ভ্যানে করে আনা হয় তেজগাঁও থানায়। সেখানে আগে থেকেই নারী ও শিশু সহায়তা ডেস্কের কক্ষটি তার জন্য বরাদ্দ করা হয়। ওই কক্ষের একটি ছোট বিছানায় তিনি রাতে ঘুমিয়েছেন। তেজগাঁও থানা সূত্রে জানা গেছে, বিলাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত সাবরিনাকে রাতে তিনজন নারী কনস্টেবল নির্ঘুম পাহারা দিয়েছেন। তাকে যেখানে রাখা হয়েছে ওই কক্ষের আশপাশে বিকাল থেকে কাউকে যেতে দেয়া হয়নি। এমনকি বিকাল থেকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া থানায় বহিরাগত কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তিনি পুলিশের মেসের খাবারই খেয়েছেন। রাতের খাবারের মেন্যুতে ছিল ভাত, সবজি, ডাল ও মাছ। সকালের নাস্তায় ছিল ভাত আলু ভর্তা, ডিম ও ডাল। গতকালও তাকে থানা পুলিশের মেসের খাবার দেয়া হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, তেজগাঁও ডিসি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ থেকে শুরু করে পরের দিন আদালতে হাজিরা পর্যন্ত সাবরিনা পরিবারের কোনো সদস্য আসেননি। কেউ খোঁজও নেয়নি এবং খাবার-কাপড় আসেনি। শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক এসেছিল তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। রোববার ডিসি কার্যালয়ে তিনি যে কাপড়ে এসেছিলেন আদালতে তিনি একই কাপড়ে যান।

নজরদারিতে ওভালের ৭ ডিরেক্টর: পুলিশি নজরদারিতে রাখা হয়েছে ওভাল গ্রুপের আরো ৭ পরিচালককে। জয়েন্ট স্টক থেকে রেজিস্ট্রেশন নেয়ার সময় গ্রুপটিতে আটজন ডিরেক্টরের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। এই আটজনের মধ্যে আরিফ চৌধুরীও একজন। পুলিশ জানিয়েছে, গ্রুপের অন্যান্য পরিচালককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তদন্ত করে দেখা হবে এই জালিয়াতির সঙ্গে তাদের কি সম্পৃক্ততা আছে। পুলিশ এও বলছে  জয়েন্ট স্টক থেকে ওভালের রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার জন্য আরিফ চৌধুরী বাকি ৭ জনের নামমাত্র নাম দিতে পারেন। বাস্তবে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নাও থাকতে পারে। তাই বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। ওভাল গ্রুপের সহযোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হলো, ওভাল কমিউনিকেশন লিমিটেড, ওভাল সিকিউরিটি প্রাইভেট লিমিটেড, ওভাল ফ্যাশনস লিমিটেড, ওভাল এডভারটাইজিং লিমিটেড ও ওভাল করপোরেশন। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। শুধুমাত্র অবৈধভাবে জেকেজি হেল্‌থ কেয়ারের কাজকর্ম চালিয়েছিল গ্রুপটি।

সাবরিনার সিম জালিয়াতি: সাবরিনা চৌধুরীর ব্যবহৃত ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে তদন্তে নেমেছে পুলিশ। জেকেজি’র তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পেরেছে দীর্ঘদিন ধরে তিনি যে মোবাইল নম্বরটি ব্যবহার করছেন সেটি অন্যর নামে রেজিস্ট্রেশন করা। পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবরিনার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি যে জাতীয় পরিচয় পত্র দিয়ে রেজিস্ট্র্রেশন করা হয়েছে সেটি পারভীন আক্তার নামের এক নারীর। ওই জাতীয় পরিচয়পত্রে তার ঠিকানা দেয়া আছে ঢাকার বাসাবো এলাকার। পারভীন আক্তারকে নিজের রোগী বলে দাবি করেছেন সাবরিনা। তিনি বলেছেন, মোবাইল নম্বরটি আমাকে একজন দিয়েছে। নম্বরটি সম্ভবত আমার কোনো রোগীর নামে রেজিস্ট্র্রেশন করা। শিগগির তিনি নম্বরটি পরিবর্তন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ মনে করছে, সাবরিনা কৌশলেই অন্যের পরিচয়পত্র দিয়ে সিম রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। যাতে করে কোনো অপরাধ করলে সেটি ধরা না পড়ে এবং সহজেই দায় এড়াতে পারেন। এছাড়া একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে পরিবারের সদস্যদের বাইরের কারো পরিচয়পত্র দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করছেন কী উদ্দেশ্য? তাই তদন্তে তার সিম রেজিস্ট্র্রেশনের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

কললিস্টে ভিআইপিদের নম্বর: জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা চৌধুরীর মোবাইল কললিস্ট ধরে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। সাবরিনা গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি জব্দ করেছে। পুলিশ তার কল লিস্টে ভিআইপিদের সঙ্গে কথা বলার রেকর্ড পেয়েছে। জেকেজি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর থেকে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলেছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসক সাবরিনার কল লিস্টে সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী থেকে শুরু করে বর্তমান এমপি, সরকারদলীয় রাজনীতি করেন এমন ব্যক্তি, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। পুলিশ ধারণা করছে, জেকেজি কেলেঙ্কারিতে সাবরিনার নাম আসার পর থেকেই সে তার সম্পৃক্ততা ও গ্রেপ্তার এড়াতে সে ভিআইপিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা, প্রবাসীরা তাদের কাছ থেকে জাল সনদ নিয়ে ইতালি থেকে ফেরত আসায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন হওয়াতে শক্ত অবস্থানে ছিল পুলিশ। তাই তার কোনো তদবিরই কাজে লাগেনি।

আরিফ সাবরিনার হেরেমখানা: জেকেজি’র সাবরিনা ও আরিফের হেরেমখানার সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। গুলশান-২ এ কনফিডেন্স টাওয়ারের ১৫ তলায় জেকেজি’র কার্যালয়েই এই হেরেমখানাটি রয়েছে বলে জানা গেছে। ২৩শে জুন জেকেজি’র সাবেক কর্মী সিস্টার তানজিনা ও হুমায়ুন কবির হিমুকে গ্রেপ্তারের পর তাদের দেয়া তথ্য মতেই পুলিশ গুলশানের ওই অফিসে অভিযান চালায়। ছয় কক্ষবিশিষ্ট ওই অফিস থেকে ল্যাপটপ, করোনার জাল সনদ, পরীক্ষার কিটসহ আরো অনেক কিছু জব্দ করে। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযানের সময় অফিসের পাঁচটি কক্ষ খোলা থাকলেও একটি কক্ষ তালাবদ্ধ ছিল। কক্ষটি কেন তালাবদ্ধ এমন প্রশ্নে আরিফ পুলিশকে জানায়, এই কক্ষের চাবি আরেক কর্মচারীর কাছে। সে বাইরে আছে। পুলিশ তখন ওই কক্ষের চাবি দেয়ার জন্য আরিফকে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু সে কিছুতেই চাবি দিতে রাজি হয়নি। একপর্যায়ে পুলিশের অভিযানিক এক কর্মকর্তা ওই কক্ষের দরজা ভাঙার নির্দেশ দেন। তখন আরিফ চৌধুরী ওই কক্ষের চাবি দেন। পুলিশ সদস্যরা ওই রুমে প্রবেশ করে দেখতে পান ফ্লোরের মধ্যে একটি বিছানা। তার পাশে বিদেশি মদের বোতল। তার পাশেই একটি ব্যাগের মধ্যে ডজনখানের কনডম রাখা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম। এছাড়া আরেকটি ব্যাগের মধ্যে করোনা টেস্টের কয়েক হাজার কিট পাওয়া যায়। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, এই কক্ষেই প্রতিদিনই মদ, ইয়াবা ও নারীর আসর বসানো হতো। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে নারীরা আসতেন। তাদের নিয়ে নাচ গান বাজনার তালে তালে নেশায় ডুবে থাকতেন আরিফসহ অন্যরা। এই আসরে আারিফের অফিসের কর্মচারী থেকে শুরু করে অংশ নিতেন বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ। পুলিশ জানিয়েছে, আরিফ দাবি করেছে এখানে তার প্রতিষ্ঠানের  রোমিও নামের এক কর্মী  স্ত্রী নিয়ে থাকতেন। অফিসের মধ্যে একজন কর্মী কেন স্ত্রী নিয়ে থাকতেন এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি আরিফ। পরে তদন্তে নিশ্চিত হওয়া যায় রোমিও আরিফের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। আরিফের সমস্ত অপকর্মের সাক্ষী। সে এই হেরেমখানার দায়িত্বে ছিল। আরিফ চৌধুরীর  গ্রেপ্তারের পর সে গা-ঢাকা দিয়েছে। এখন তাকে খোঁজা হচ্ছে। এর বাইরে পুলিশ খোঁজখবর নিচ্ছে ডা. সাবরিনার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর। রনি নামের ওই বন্ধু পেশায় ব্যবসায়ী। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসায় থাকেন। সাবরিনা নিজে গাড়ি চালিয়ে ওই বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন বলে অভিযোগ আছে। রনির সঙ্গে তার কি সম্পর্ক, কেন নিয়মিত তার বাসায় যেতেন, জেকেজি’র প্রতারণার সঙ্গে রনির কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

বিসিএস ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দিতেন আরিফ! ২০১৮ সালে বিসিএস ক্যাডারদের ৬৬তম ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্সে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন জেকেজি’র প্রতারক আরিফ চৌধুরী। সম্প্রতি করোনা টেস্ট কেলেঙ্কারিতে আরিফ চৌধুরী গ্রেপ্তারের পর ওই ট্রেনিং এ অংশগ্রহণকারী ক্যাডারদের বিষয়টি নজরে আসে। এমনকি জেকেজি কেলেঙ্কারি নিয়ে পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তাও ওই ট্রেনিং এ উপস্থিতি ছিলেন। ট্রেনিং এ অংশগ্রহণকারী  একাধিক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, পুলিশের অনেক বড় কর্মকর্তাও ওই প্রশিক্ষণে ক্লাস নেয়ার সুযোগ পান না। এছাড়া অনেক সময় আমাদের পছন্দের কেউ থাকলে তাকেও সিলেক্ট করা যায় না। অথচ এই ধরনের প্রতারকরাও বিসিএস ক্যাডারদের ট্রেনিং করায়। বিষয়টি খুব লজ্জাজনক। যার প্রশিক্ষণ নিয়েছি সেই ব্যক্তি এখন প্রতারক হিসেবে ধরা খেয়ে কারাগারে আছেন।

সম্পদের তদন্ত করবে দুদক: জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে দুদক জানায়, সরকারি চাকরিতে বহাল থেকে তার স্বামী আরিফ চৌধুরীর সহায়তায় প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে ১৫ হাজার ৪৬০টি ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে তারা ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া তাদের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগসমূহ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। এর আগে কমিশনের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগগুলো বিভিন্ন ব্যক্তি, গণমাধ্যম, ভার্চুয়াল, মাধ্যমসহ বিভিন্ন উৎস হতে ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ সংগ্রহ করেছে। এসব তথ্য-উপাত্ত সংবলিত অভিযোগসমূহ কমিশনের দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল কমিশনে উপস্থাপন করলে কমিশন এ সিদ্ধান্ত নেয়। কমিশনের বিশেষ তদন্ত অনুবিভাগের মাধ্যমে এই অভিযোগ তদন্ত করা হবে। এর আগে জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান সাবরিনা চৌধুরী ও সিইও আরিফ চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)।

আরও খবর