রাজবংশী রায় ◑ দেশে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে ঊর্ধ্বমুখী ধারা চলছে। প্রায় প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হচ্ছে। হাসপাতালে করোনার আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা পাওয়ার সম্ভাবনাও সীমিত হয়ে আসছে। এখনই শয্যার অভাবে অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। ফলে বাসাবাড়িতে এখনও অনেকে মৃত্যুবরণ করছেন।
এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগছে, এ অবস্থা আর কতদিন চলবে। আর কতসংখ্যক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করবেন? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিদরাও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন। চলমান পরিস্থিতিতে করোনায় দেশে আরও কত মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করতে পারেন, তা নিয়ে নতুন করে একটি পর্যালোচনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
প্রতিষ্ঠানটির জনস্বাস্থ্যবিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির ওই পর্যালোচনায় দেখা যায়, সংক্রমণের চলমান ঊর্ধ্বমুখী ধারা আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এই সময়ে আরও এক লাখ ২৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে গিয়ে সংক্রমণের মাত্রা নিম্নমুখী হতে শুরু করবে। বর্তমানে মৃত্যুহার রয়েছে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তা বেড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
নতুন পূর্বাভাসের বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের আট সদস্যের এই কমিটির প্রধান ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, দেশে বর্তমানে করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ বা পিক টাইম চলছে। আগামী জুলাই মাসজুড়ে সংক্রমণের এই ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। এই সময়ে আরও এক লাখ ১৫ হাজারের মতো মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেন। এরপর আগস্ট মাসের শুরুতে সংক্রমণ নিম্নমুখী হতে শুরু করবে। এভাবে ধাপে ধাপে সংক্রমণের মাত্রা হ্রাস পেতে থাকবে।
ডা. শাহ মনির বলেন, এই পূর্বভাসের বাস্তবতা কিংবা কার্যকারিতা নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর। অর্থাৎ সরকার জোনভিত্তিক যে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে পারলে এই পূর্বাভাস হয়তো মিলবে। কিন্তু আগের মতো (নিয়ন্ত্রণহীন) পরিস্থিতি হলে এটি কাজে আসবে না। তখন সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই আরও বাড়বে। সুতরাং কার্যকর লকডাউন, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে ঘরে অবস্থান করলেই কেবল আগস্টে গিয়ে সংক্রমণের মাত্রা নিম্নমুখী হবে। কিন্তু এগুলো মেনে না চললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
আগের পূর্বাভাস কার্যকর হয়নি :এর আগে গত এপ্রিল মাসের শেষ দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিদদের দেওয়া পূর্বাভাসের কার্যকারিতা পাওয়া যায়নি। তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তারা দুই ধাপে পৃথক দুটি পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। প্রথমটিতে তারা ধারণা দিয়েছিলেন, ওই সময়ে সংক্রমণের যে মাত্রা ছিল সেই ধারা অব্যাহত থাকলে মে মাসে ৪৮ থেকে ৫০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। দ্বিতীয় ধাপে তারা বলেছিলেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে সংক্রমণের মাত্রা বাড়বে এবং সেটি দ্বিগুণ হয়ে এক লাখে পৌঁছাতে পারে। একই সঙ্গে মৃত্যু হতে পারে আটশ’ থেকে এক হাজার মানুষের।
সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও বাড়লে কিংবা মারাত্মক আকার ধারণ করলে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে এক লাখে পৌঁছাতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারাতে পারেন। জুনের মাঝামাঝি গিয়ে সেটি কিছুটা কমে আসবে। কিন্তু গতকাল বুধবার ১৬ জুন পর্যন্ত দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৯৫ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। মৃত্যুর সংখ্যাও সাড়ে ১২শ’ ছাড়িয়েছে।
আগের পূর্বাভাস কার্যকর না হওয়ার কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. শাহ মনির বলেন, তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ওই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। ২৬ মার্চ সরকারি ছুটি ঘোষণার পর সব অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের ধারণা ছিল, ছুটির পর মানুষ ঘরে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ছুটি ঘোষণার পর হাজার হাজার মানুষ গ্রামে চলে যায়। মাঝখানে গার্মেন্টস মালিকরা ছুটি বাতিল করে শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনে। আবার তাদের ফেরত পাঠানো হয়। একই সঙ্গে ঈদের আগে সীমিত পরিসরে দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়।
এমনকি ঈদের ছুটিতে হাজার হাজার মানুষ ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে গ্রামে আসা-যাওয়া করে। এরপর ৩১ মার্চ থেকে ছুটি বাতিল করা হয়। এই ঘটনাগুলোর সবই করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী করার জন্য দায়ী। সুতরাং আগের পূর্বাভাস ঠিক থাকার কথা নয়। এখনও বলছি, জোনভিত্তিক লকডাউন দ্রুততম সময়ে কার্যকর করা গেলে বর্তমানে যে পূর্বাভাস দিয়েছি তা মোটামুটি ঠিক থাকবে। অর্থাৎ জুলাই মাস পর্যন্ত সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকবে এবং আগস্টের শুরু থেকে তা নিম্নমুখী হতে শুরু করবে। কিন্তু কার্যকর লকডাউন, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সুরক্ষিত থাকা না গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
আইসোলেশন শয্যা, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সুবিধা বাড়ানোর তাগিদ :করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা নিয়ে গত ২১ এপ্রিলের ওই ভার্চুয়াল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদদের করা ওই পর্যালোচনা আমলে নিয়ে বেশকিছু কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়।
বৈঠকে উপস্থিতি একাধিক সূত্র সমকালকে জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধে তিন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। এর প্রথমটি হলো সামাজিক দূরত্ব এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা কঠোরভাবে বজায় রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক আইসোলেশন শয্যা, ভেন্টিলেটর এবং আইসিইউ বেড প্রস্তুত করতে হবে। তৃতীয়ত, সংক্রমণ বন্ধ করতে আরও বেশি করে পরীক্ষা করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ২০ শতাংশকে হাসপাতালে রেখে যত্নের প্রয়োজন। বাকি ৮০ শতাংশ বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে পারবেন। সভায় জানানো হয়, যে ২০ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হবে, তাদের জন্য আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটর এবং আইসোলেশন শয্যা নেই। এগুলো দ্রুত বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু তা আজও কার্যকর হয়নি বলে জানান সংশ্নিষ্টরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক সমকালকে বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ এবং অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। তখন ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হয়। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার আইসিইউ শয্যা প্রয়োজন। অথচ করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৪০০ আইসিইউ ব্যবস্থাও নেই। হাসপাতালে হাসপাতালে অক্সিজেনের সংকট। প্রয়োজন আছে এমন রোগীরা অক্সিজেন পাচ্ছে না।
তাহলে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ এতদিন কী কাজ করেছে, এটি জানতে চাওয়া উচিত। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দ্রুততম সময়ে জেলায় জেলায় আইসিইউ ইউনিট চালুর আহ্বান জানান তিনি।
প্রস্তুতি সন্তোষজনক নয়, মত বিশেষজ্ঞদের : করোনা মোকাবিলায় সরকার যে প্রস্তুতি নিয়েছে তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তাদের অভিমত, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যকরের কথা বলা হলেও মাঠে তার বাস্তবায়ন নেই। কিন্তু এ সময়ে আরও প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগ চলছে শম্বুক গতিতে। এতে ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
করোনা নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, করোনা প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ অনেকটা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। কারণ কোনো কিছুই তারা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। ভাইরাসটি প্রতিরোধে দ্রুততম সময়ে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন তা করা হচ্ছে না।
দেশকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন- এই তিন জোনে ভাগ করে কার্যক্রম গ্রহণের কথা ১৫ দিনেরও বেশি আগে বলা হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত কাজটি সেভাবে করা যায়নি। এভাবে তো ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করা যাবে না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাষ্য :সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, জোনভিত্তিক করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে পূর্ব রাজাবাজারসহ নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার কয়েকটি এলাকায় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দেশের বাকি এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে ধাপে ধাপে এই কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-