নিজস্ব সংবাদদাতা ◑
কক্সবাজারে চকরিয়া উপজেলার মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির গাড়ি আটক বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। মাসিক টুকেন বাণিজ্য, যানবাহন আটক করে টাকা আদায়, দালালদের উৎপাত ইত্যাদির অভিযোগ ফাঁড়ির বিরুদ্ধে। হিসাব না মিললে জুড়ে দেয়া হয় মামলা।
হিসাব-নিকাশ ঠিকঠাক থাকলে ‘সাতখুন’ মাফ -এমনটাই অভিযোগ যানবাহন সংশ্লিষ্টদের।
ভুক্তভোগিরা জানিয়েছে, কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও থেকে চকরিয়া পর্যন্ত মহাসড়কে নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার বদৌলতে চলছে জোরজুলুম।
হয়রানির শিকার হচ্ছে যানবাহন সংশ্লিষ্টরা। দিনে আটক করে রাতে ছাড়; রাতে আটক অবার দিনে ছাড়, এভাবে চক্রাকারে চলছে প্রতিনিয়ত। মূলতঃ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার অনৈতিক কাজের জন্য বদনাম হচ্ছে মহাসড়ক পুলিশের। সেইসাথে মাত্র কয়েক জনের অবৈধ আয়ের কারণে যানবাহন খাত থেকে প্রতিমাসে সরকার হারাচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকার রাজস্ব।
মোঃ নিজাম উদ্দিন নামের স্থানীয় একজন সংবাদকর্মী কিছুদিন আগে নিজের ফেসবুকে লিখেন, তিনচাকার যান আটক করে ৭-১২ হাজার টাকা নিয়ে রাতের আঁধারে ছেড়ে দিচ্ছে।
প্রতিনিয়ত চক্রাকারে ফাঁড়ি পুলিশের নেয়ে এতগুলো টাকা আদৌও সরকার পাচ্ছে কিনা? রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এমন একটি পোস্ট তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে প্রকাশ করলে ফাঁড়ির ইনচার্জ তার উপর ক্ষেপে যান। পরে থানা পুলিশের মাধ্যমে ওই সংবাদকর্মীকে নানাভাবে ফাঁসাতে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। যদিওবা এমনটি অস্বীকার করেছেন ওসি।
অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে, স্থানীয় কয়েকজন দালালের নিয়ন্ত্রণে চলছে মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সকল কার্যক্রম। তাদের মাধ্যমে মহাসড়ক থেকে বৈধ-অবৈধ গাড়ি আটক করা হচ্ছে। একেকটি গাড়ি থেকে ৮-১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে রাতের আঁধারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
বৈধ-অবৈধ বাছবিচার করা হয় না। কোন চালক টাকা দিতে না পারলে গাড়িগুলো ২ মাস পর্যন্ত ‘কাস্টোডি’র নামে জব্ধ করে ফাঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আবু বক্কর নামে এক দালালের মাধ্যমে তিন চাকার প্রতিটি গাড়ি থেকে মাসিক ১৫০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। যে সব চালকেরা টাকা দিবে না তাদের গাড়ি আটকে রেখে মামলার ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক টাকা আদায় করা হয়।
জাহাঙ্গীর আলম নামের এক সিএনজি চালক অভিযোগ করেন, অনেক দুঃখ কষ্ট করে তিনি একটি সিএনজি কিনেন। এই সিএনজির টাকায় তার সংসার চলে। শবে বরাতের ফাতেহার দুইদিন আগে তার গাড়ি আটক করে হাইওয়ে পুলিশ। দুই দিন পরে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। টাকাগুলো জোগাড় করতে তার অনেক কষ্ট হয়েছে। ওই সিএনজি চালক জাহাঙ্গীরের বাড়ি সদরের ঈদগাঁও খোদাইবাড়ি এলাকায়।
একই অভিযোগ আবদুল্লাহ নামক সিএনজি চালকের। তিনি জানান, গত রোজার শুরুতে তার সিএনজি দৌঁড়িয়ে ধরে ৩ হাজার টাকা আদায় করে। প্রায় ছয়মাস পর আবারো ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এখন হাইওয়ে পুলিশের ভয়ে আর সেই দিকে গাড়ি চালাতে যাচ্ছেন না তিনি। সিএনজি চালক আবদুল্লাহর বাড়ি চকরিয়া উপজেলার সাহারবিলে। কিছু দিন আগে ৮ হাজার টাকা দিয়ে ছাড় পান ডুলাহাজারা রংমহলের অটো রিকশা চালক সাজ্জাদ।
তারা সকলের অভিযোগ, তিন চাকার গাড়ি থেকে চাঁদাবাজি করে আসছে আবু বক্করসহ আরো কয়েকজন দালাল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাইওয়ে পুলিশের সাথে সম্পর্ক আছে এমন এক ব্যক্তি জানান, তিন চাকার গাড়ি থেকে মাসিক আয় অন্তত ১০ লক্ষ টাকা। কয়েকজনে মিলে এ টাকাগুলো ভাগবাটোয়ারা করে। নির্ধারিত টুকেনের বাইরে সড়কে গাড়ি পেলেই আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। সব দেখভাল করেন ক্যাশিয়ার ও মুন্সি হান্নান। তাদের হাত ধরে অবাধ বিচরণ দালাল সিন্ডিকেটের। এভাবে বছর খানেক ধরে এ হাইওয়ে ফাঁড়িতে চলছে দালাল ও পুলিশের রামরমা কার্যক্রম।
মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে দালালী, ঘুষ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও আটক বানিজ্য অতীতের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। পুলিশের ভয়ে এসবের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।
চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতেও মহাসড়কে চাঁদাবাজি চলছে জনসম্মুখে। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলে চকরিয়া উপজেলার মেধা কচ্ছপিয়ার ঢালা, ডুলাহাজারা স্টেশন, বনানী, সাফারি পার্ক গেইট, তার উত্তরে ব্রিজের উপর, পুলিশ ফাঁড়ির গেইট, মালুমঘাট বাজারের উত্তরে রিংভং এলাকা এবং তারও উত্তরে মইক্ষাঘোনা নামক পয়েন্টে গাড়ী দাঁড় করিয়ে চলে চাঁদা আদায়।
যানবাহন সংশ্লিষ্টের অভিযোগ- জয়নাল আবেদীন সোনামিয়া (প্রকাশ গাছসোনা), শাহাব উদ্দিন, শাহাজাহান সহ আরো কয়েকজন মাসিক মাসোহারা, টুকেন বানিজ্যসহ এখানকার বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির ধারক বাহক।
তারা মালুমঘাট হাইওয়ে ফাঁড়ির দালালী করে একেকজন কোটিপতি।
ফাঁড়ির ইনচার্জ সরাসরি কোন টাকা পয়সার লেনদেন করেন না। সম্পর্ক রয়েছে এসব দালাল সিন্ডিকেটের। তাদের মোবাইলের ফোনলিস্ট চেক করলে অনায়াসে মিলবে সত্যতা এবং বেরিয়ে আসবে জোর জুলুমের অনেক গোপন রহস্য। সন্ধ্যা হলেই ফাঁড়িতে আসা যাওয়া চলে দালালদের। আবার অনেকের সাথে যোগাযোগ হয় নির্দিষ্ট সময়ে। এভাবেই চলছে মহাসড়কে অনিয়ন্ত্রিত, অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন।
সচেতন মহলের প্রশ্ন- দিনরাত আটক আর ছেড়ে দেয়া টমটম, অটোরিক্সা, সিএনজিগুলো থেকে নেয়া টাকার কোনপ্রকার মামলা বা মানি রিসিভ দেয়া হচ্ছে না। এর থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ টাকা আয় হয় তা সরকারী কোষাগারে যাচ্ছে কিনা ?
এ প্রসঙ্গে মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির মুন্সি ও ক্যাশিয়ার মোঃ হান্নানের সাথে শনিবার (১৩ জুন) বেলা দেড়টার দিকে মুঠোফোনে কথা হয়।
তিনি জানান, বিগত প্রায় ২ মাস ধরে কোন গাড়ি আটক করলে ছাড়া হয় না। তা উপরের নির্দেশ। অফিসিয়াল প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেয়া হয়। দালাল সিন্ডিকেট বা গাড়ি আটকিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ সত্য নয়। এসবের সঙ্গে নিজের কোন সম্পৃক্ততা নেই দাবী মুন্সি হান্নানের।
এরপর মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোর্শেদুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয়।
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, সরকার ও আদালতের আদেশ মতে তার এলাকায় কোন সিএনজি, অটোরিকশা চলতে দেয়া হয় না। যে কারণে কিছু লোক ক্ষুব্ধ হয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। গাড়ি আটক বা ছাড় নিয়ে টাকা পয়সার লেনদেনে তার কোন সম্পর্ক নেই। সত্যতা যাচাই করতে তিনি প্রতিবেদককে সরেজমিনে ফাঁড়িতে আমন্ত্রণ জানান।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-