বিপদ সংকেত দিচ্ছে করোনা

যুগান্তর ◑

দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিনই শনাক্তের পাশাপাশি মৃতের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। একদিনে গড়ে প্রতি মিনিটে ২ জন করে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় মারা গেছেন গড়ে একজনের বেশি। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ ভয়াবহ আকারে বাড়তে থাকে, যা এখনও অব্যাহত।

এর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে মৃতের সংখ্যাও। রোগতাত্ত্বিকভাবে এই পরিস্থিতিকে দেশের জন্য ‘বিপদ সংকেত’ বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, অতিদ্রুত সাবধান হতে হবে। নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা। আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে না পারলে পরিস্থিতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এটা প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে না, সমন্বিতভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

তাদের মতে, কয়েক দফায় অপরিকল্পিতভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকা থেকে যাওয়া-আসার কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বর্তমানে ঢাকাসহ সারা দেশে বাস, ট্রেন, লঞ্চে অবাধ যাতায়াতের কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন।

রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রাক্তন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, রোগীর সংখ্যা ও মৃতের হার যেভাবে বাড়ছে এটা দেশের জন্য বিপদ সংকেত দিচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে না পারলে পরিস্থিতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

এটা প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে না, সমন্বিতভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তিনি বলেন, ব্রাজিলের সরকার ভেবেছিল প্রকৃতিগতভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হবে। তাই তারা সবকিছু স্বাভাবিক রেখেছিল। কিন্তু এরপর সে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ডা. মুশতাক বলেন, ভাইরাসটি ধীরে ধীরে শুরু করে প্রকটভাবে ছড়াতে থাকে।

তাই সে ধরনের ভয়াবহতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দিয়েছেন তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত এলাকায় (রেড জোন) টোলারবাগ বা শিবচরের মতো ‘কমপ্লিট লকডাউন’ করতে হবে। অপেক্ষাকৃত কম সংক্রমিত এলাকায় (ইয়েলো জোন) চলাচল সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কম সংক্রমিত (গ্রিন জোন) এলাকায় পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।

রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম পরীক্ষা শুরু হয় ২১ জানুয়ারি। প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। ওই দিন ৩ জন রোগী শনাক্ত হয়। এরপর এক-দু’দিন পর পর দুই-তিনজন করে রোগী শনাক্ত হতে থকে। মূলত এপ্রিল মাস থেকেই আক্রান্তের হার বাড়তে থাকে।

এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৪৮২ ছিল। এরপর ২০ এপ্রিল পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৬ গুণের বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ২৯৪৮ জনে। পর্যায়ক্রমে ১১ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই সংখ্যা ১৫ গুণের বেশি বেড়ে ৭৯৯৭ জনে উন্নীত হয়। এরপর ১০ মে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪,৬৫৭ জনে, ২০ মে এই সংখ্যা ছিল ২৬ হাজার ৭৩৮ জন এবং ৩১ মে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৭ হাজার ১৫৩ জনে।

অর্থাৎ ১১ এপ্রিল থেকে মাত্র ৫৪ দিনের মাথায় রোগী ৯৮ গুণ বেড়ে ৫৫ হাজার ১৪০ জনে দাঁড়িয়েছে। শুরুতে শুধু আইইডিসিআর নমুনা পরীক্ষা করায় শনাক্তের সংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি। এরপর পর্যায়ক্রমে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নমুনা পরীক্ষা শুরু হলে শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথম দিকে ঢাকার পর নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর সংক্রমণের হটস্পট ছিল। এখন সংক্রমণের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে চট্টগ্রাম।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমন্বিত কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী বুধবার ৩৭ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশে নতুন করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৪৬ জন। ওই দিন আক্রান্ত হয়েছেন আরও ২ হাজার ৬৯৫ জন। সব মিলিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার ১৪০ জনে।

দুই জুন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ছিল যখাক্রমে ২৯১১ জন এবং ৩৭ জন, ১ জুন এই সংখ্যা ছিল ২৩৮১ জন এবং ২২ জন, ৩১ মে ছিল যথাক্রমে ২৫৪৫ জন এবং ৪০ জন। অন্যদিকে ঈদের আগে ২৪ মে আক্রান্ত ছিল ১৫১৩ জন এবং মৃত্যু ২৮ জন, ২৩ মে আক্রান্ত ছিল ১৮৭৩ জন এবং মৃত্যু ২০ জন, ২২ মে আক্রান্ত ছিল ১৬৯৪ জন এবং মৃত্যু ২৪ জন। এই পরিসংখ্যান থেকেই ঈদের আগে ও পরের আক্রান্ত ও মৃতের হার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউনের কিছুদিন পর গার্মেন্ট খোলার খবর এবং ঈদের আগে-পরে দেশব্যাপী রাজধানীর মানুষের অবাধ যাতায়াতের কারণে স্থানীয় পর্যায়ের মৃদু সংক্রমণ এবং ঢাকার উচ্চ সংক্রমণের ধারার সংমিশ্রণ ঘটেছে। এই সময়ে ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তনও লক্ষ্য করা গেছে। এতে স্থানীয় পর্যায়ে করোনাভাইরাসের তীব্র সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। স্বল্প সময়ে এর স্বরূপ

উন্মোচিত হবে। এতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা সামাল দেয়ার মতো অবস্থা স্বাস্থ্য খাতের কতটা আছে তা বিবেচনা করা দরকার।

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, যেভাবে রোগী বাড়ছে সেটা থেকে বোঝা যায় দেশের করোনা সংক্রমণের হার আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন ঊর্ধ্বমুখী। এটাকে যতদ্রুত সম্ভব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে। নয়তো সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

আইইডিসিআরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে পুরুষ ৭১ ভাগ এবং নারী ২৯ ভাগ। মোট শনাক্ত রোগীর মধ্যে ১ থেকে ১০ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২ দশমিক ৯ ভাগ; ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী ৭ দশমিক ৩ ভাগ; ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী আক্রান্তের হার ২৭ দশমিক ৬ ভাগ; ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী আক্রান্তের হার ২৭ দশমিক ১ ভাগ; ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের আক্রান্তের হার ১৭ দশমিক ৩ ভাগ; ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে সংক্রমণের হার ১১ দশমিক ২ ভাগ এবং ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের আক্রান্তের হার ৬ দশমিক ৭ ভাগ।

একইভাবে মৃতের হার ১ থেকে ১০ বছর বয়সীদের মধ্যে ১ দশমিক ০১ ভাগ; ১১ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে ১ দশমিক ৮৫ ভাগ; ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী মৃতের হার ৩ দশমিক ৫২ ভাগ; ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী মৃতের হার ৮ দশমিক ৫ ভাগ; ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃতের হার ১৭ দশমিক ১১ ভাগ; ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃতের হার ৩১ দশমিক ৮ ভাগ; এবং ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মৃতের হার ৩৭ দশমিক ১ ভাগ।

৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এ বয়সীদের আক্রান্তের হার ১৭ দশমিক ৩ ভাগ। অপর বয়স্করাই বেশি মারা যাচ্ছেন। ৬০ বছর থেকে বেশি বয়সীদের মৃত্যুর হার ৩৭ দশমিক ১ ভাগ। যুবক শ্রেণি বেশি আক্রান্ত হওয়া সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে এরা সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করেছে বেশি।

অর্থ উপার্জনসহ নানা অজুহাতে এরা ঘর থেকে বেশি বের হয়েছেন। পাড়ার দোকানসহ স্থানীয় বাজারে আড্ডা দিয়ে সময় পার করেছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেননি। রক্ষা করেননি সামাজিক দূরত্ব। ফলে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। অপরদিকে বয়সের পাশাপাশি নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ায় করোনা বেশি কাবু করে ফেলেছে বয়স্ক লোকদের।

করোনা আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৭৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ২৪১ জন, ঢাকা শহর ব্যতীত ঢাকা বিভাগে ২১২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ৯ জন, রংপুর বিভাগে ২১ জন, খুলনা বিভাগে ১১ জন, বরিশাল বিভাগে ১৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ২৪ জন।

এছাড়া রোগী শনাক্তকরণ ল্যাবরেটরি বা পিসিআর ল্যাব সক্রিয় রয়েছে ৫০টি। যার ২৭টি ঢাকায় এবং ২৩টি ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে।

করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য দেশব্যাপী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে আইসোলেশন শয্যা রয়েছে ১৩ হাজার ৯৮৪টি, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৩৯৯টি এবং ডায়ালাইসিস সেবা শয্যা রয়েছে ১০৬টি। তবে আইসোলেশন শয্যা এবং আইসিইউ শয্যা দেশের সব বিভাগীয় শহরে থাকলেও ডায়ালাইসিস শয্যা ঢাকার বাইরে আর কোথাও নেই। ফলে কিডনি রোগীর করোনায় আক্রান্ত হলে সমস্যা বেশি হচ্ছে। এ ধরনের রোগীর ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে উঠছে।

আরও খবর